পিচ্চি বউ নিয়ে আজকের গল্প । আজকের গল্প  পিচ্চি বউ । খুব দুষ্টু মিষ্টি একটি গল্প পিচ্চি বউ ।


শুরু করছি আজকের গল্প পিচ্চি বউ নিয়ে ।


~গ্রাজুয়েশন শেষ করে সবেমাত্র বাবার ব্যবসায় মন নিবেশ করেছি, সারাদিন যন্ত্রণা সহ্য করে ফিরেই দেখি আম্মু টিভির সামনে মনমরা হয়ে বসে আছে। বুঝলাম তুফান শুরুর  আগের শান্তি।
-কি হয়েছে আম্মু?
-কি আর হবে?
-চুপ করে আছ কেন?
-তাহলে কি চেঁচামেচি করব?
-ইচ্ছা হলে করতে পার।
-থাম তুই।
-আচ্ছা।
.
কিছু না বলে নিজের রুমে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর আম্মু নিজেই খাবার খেতে ডাকছে। টেবিলে গিয়ে বিড়ালের মত বসে পরলাম, খাবার তুলে দিয়ে শুরু করল,
-তুই আর তোর আব্বু, সারাদিন বাইরে থাকিস, আমি একা  কি করব বাসায়?
-পয়েন্ট। কি করতে পারি?
-বলছিলাম কি বাবা, তুই একটা বিয়ে করে ফেল। গার্লফ্রেন্ড-ঠ্রেন্ড থাকলে বল আমরা দেখে শুনে...
-কি শুরু করলে আম্মু?
-আছে নাকি কেউ?
-না।
-তাহলে চল, কালকে আমরা মিথিলা’দের বাসায় ঘুরে আসি। তোর মামা অনেক দিন ধরে ফোন দিচ্ছে যাওয়ার জন্য।
-তুমি যাও। আমি অফিস শেষ করে চলে আসব। আর আপাতাত বিয়েশাদী করার ইচ্ছা নেই।
-ঠিক আছে বাবা। ভুল করিস না কিন্তু।
.
কিছু না বলে রুমে চলে আসলাম। মিথিলা, আমার মামাতো বোন, একসাথে বড় হয়েছি, যদিও আমার থেকে বছর তিনেকের ছোট। আসলে তাকে মেয়ে না বলে গুন্ডী বললে বেশি মানাবে। খুব ঝগড়ুটে টাইপ মেয়ে, তবে মানুষ হিসেবে খুব একটা খারপ না। আগে পাশাপাশি থাকতাম তবে ব্যবসার সুবাধে আমাদের ঢাকাতে চলে আসতে হয়েছে। আর মামা তার প্রিয় শহর চিটাগং এ রয়ে গেছেন। প্রায় ৮ বছর দেখা হয় নি তাদের সাথে।
.
পরের দিন অফিস শেষ করে বিকেলের ফ্লাইটে চিটাগং চলে গেলাম, গাড়ি পাঠিয়েছে তাই সোজা বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতে ঢোকার আগেই আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল, পুরো বাড়ি বিয়ের সাঁজে সাজানো, চারিদিকে আমাদের প্রায় সব আত্মীয়স্বজন দেখতে পাচ্ছি। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে প্রায় সবাই আমার উপর হামলে পড়ল। তা মামুলি ব্যাপার, অনেক দিন পর দেখা, কিন্তু বাড়ি সাজানো কেন আর সবাই একত্রে এখানে কেন এইটুকু জিজ্ঞাসা করার মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না, একটু এগুতেই দেখি আমার বাচ্চাকালের বন্ধু রাফিদ,
-কি রে দোস্ত, কেমন আছিস?
-ভালো ছিলাম।
-এখন কি হয়েছে?
-তারপর আব্বু-আম্মু ধরে বিয়ে করিয়ে দিল
-হাহা, ভাবী কেমন আছে, কোথায় সে?
-সে ভালোই আছে, তোর বউ সাজাচ্ছে?
-মজা নিচ্ছিস?
-একটুও না। আন্টিই তো সব করেছে। গিয়ে দেখ আঙ্কেলও উপরে আছে।
.
মজা হিসেবে নিয়েই উপরে চলে গেলাম, গিয়ে দেখি আব্বু সত্যিই এখানে, ভাবলাম হয়ত মিথিলার বিয়ে তাই সবাই এসেছে, আর রাফিদ, মামার পরিবারের অতি ঘনিষ্টজন, তাই হয়ত এসেছে।
-আব্বু, আপনি এখানে কেন?
-ছেলের বিয়েতে থাকব না?
-আপনিও শুরু করলেন?
-মোটেই না, চল আমার সাথে।
.
প্রায় আসামীর মত ধরে আমাকে নিয়ে গেল একটা রুমে, গিয়ে দেখি আম্মু সাথে খালামনিরা সবাই ব্যস্ত পাঞ্জাবি পছন্দতে। আমাকে দেখে মনে হয় আকাশে চাঁদ হাতে পেয়েছে। আম্মু কিছু না বলে মিট মিট করে হাসছে। রাগে আমার চেহারা রীতিমত লাল হয়ে গেছে, ভদ্রতার কারণে কিছু বলতেও পারছি না। বুঝলাম যে অবস্থা, সব কিছু আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে, এখন হেরে যাওয়া সৈনিকের মত দেখা ছারা কিছু করার নেই। সবাই সাজ সজ্জায় লেগে আছে, একাই বাড়ির ছাদে চলে গেলাম, গিয়ে দেখি মিথিলাও দাঁড়িয়ে আছে,
-ঐ, তুই এখানে কেন?
-কি আর করব?
-সেটাই কথা, এত বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমাকে জানাস নি কেন?
-আমি নিজেই জানি না, আজকে সকালে ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছি আব্বু বলেছে নানাভাই অসুস্থ তাড়াতাড়ি চলে আসতে, এসে দেখি এই অবস্থা।
-আমি তোকে বিয়ে করতে পারব না!
-আমি কি বসে আছি নাকি তোকে বিয়ে করার জন্য?
-দেখ তোর মত  পিচ্চির সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই। কিছু একটা কর
-কি করব?
-তোর বয়ফ্রেন্ডের নাই?তার সাথে পালিয়ে যা!
-বয়ফ্রেন্ড পাবো কোথায়?
-খারাপ বলিস নি, কে ই বা গুন্ডীর বয়ফ্রেন্ড হতে চাইবে?
-দেখ অভ্র, তোকে সাবধাণ করে দিচ্ছি আমাকে পিচ্ছি আর গুন্ডী বলবি না।
-কি, কি করবি হ্যাঁ?
ও কিছু একটা বলতে চেয়েছিল তার আগে মামা এসে হাজির হয়,
-আরে তোরা এখানে কেন? চল নিচে চল। কত সাঁজ গোঁজ বাকি।
.
আসলে রাগ টা কার উপর করব বুঝতে পারছি না। সবাই একদিকে, কিছু করার উপায়ও খুঁজে পাচ্ছি না। হাল ছেড়ে দিয়ে যা হচ্ছে হতে দিলাম, যথারীতি আমাকে কোরবানী দুঃখিত বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। রাত্রে মামার বাড়িতেই থাকতে হল, বন্ধু-বান্ধব সবাই ধরে আমাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল, গিয়ে দেখি মিথিলা বঊ সেজে বসে আছে, হুট করে গিয়ে সোফায় বসে পরলাম, চিন্তা করতে পারছি না কি থেকে কি হয়ে গেল। মিথিলা তার ঘোমটা তুলে আমাকে দিকে তাকিয়ে আছে, যাকে বলে অগ্নি দৃষ্টি,
-কিছু বলবা বউ?
-কিসের বউ কার বউ?
-সেটাই হচ্ছে আসল কথা, তোর মত একটা পিচ্ছি মেয়ে কিভাবে আমার বউ হয়?
-অভ্র, তোকে আমি আগেই সাবধান করেছি, আর যাকেই হোক তোকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার কোনো কালেই ছিল না!
-আমার ছিল মনে হয়?
-তাহলে করলি কেন?
-করলাম কোথায়? ধরে করিয়ে দিল!
-কি রকম পুরুষ একটা বিয়ে ভাঙ্গতে পারলি না!
-সে সময় টুকুই তো পেলাম না
-জাহান্নামে যা
-সেটা পরে দেখা যাবে, এখন সর আমি ঘুমোব, খুব ঘুম পেয়েছে।
-ঘুমা, কে ধরে রাখছে?
-খাট থেকে নাম।
- অসম্ভব, খাটের ধারে কাছে আসলে তোর খবর আছে।
-কি করবি হ্যাঁ?
-খুন করে ফেলব
-গুন্ডী কি আর শখ করে বলি?
কোন কথা না বলে ফ্রেস হয়ে এসে শুয়ে পরে সে,
-এই মিথু, শোন না, আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি সমস্যা নেই, তবে ক্ষুদ্র পরিসরে একটা মানবিক আবেদন, তোর কোলবালিশটা একটু দিবি?
-না।
বলেই ঘুমিয়ে পরে। স্বয়ং উপরওয়ালা মালুম, এই মেয়েকে নিয়ে কিভাবে সংসার করব...
.
.
.
 



(আগের পর্বগুলো আমার টাইমলাইনে দেওয়া আছে)
~কাল থাইল্যান্ড যেতে হচ্ছে হানিমুনে। এক রকম জোর করে পাঠাচ্ছে বাবা। বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই এহেন গুণ্ডি বউ নিয়ে হানিমুনে যেতে। যেহেতু বাবা বলেছে তাই ফাঁকি দেওয়ার উপায় বের করাও মুশকিল। সন্ধ্যার দিকে জিনিস পত্র গোছানো শুরু করতে যাবো, ওয়ারড্রপ খুলে দেখি আমার অর্ধেক জামা কাপড় হাওয়া। সেখানে বউ আমার স্বযত্নে নিজের শাড়ির দোকান বসিয়েছে। রাগে ফেটে পরলাম,
-মিথুউউউউউউউউউউউউউউউউউউহ
- সমস্যা কি তোর হ্যাঁ?
-আমার বাকি জামাকাপড় কোথায়?
-ফুপ্পির কাছে দিয়ে এসেছি।
-আমার ড্রয়ারে হাত দিয়েছিস কেন?
-তো?
-তো মানে? সাহস হল কেমন করে?
- আমি না তোর বউ?
-বউ তো কি?
.
হয়ত বুঝেছে রাগ করেছি, তাই কথা না বাড়িয়ে আম্মুর কাছে গিয়ে জামাকাপড় গুলো সুবোধ বালিকার মত নিয়ে আসল।
-ব্যাগ গুছিয়ে নে।
সে কোনো কথা না বলে ব্যাগ গুছানো শুরু করল।
আমার প্রায় শেষ। ব্যাগে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। এখন বাঁধল মহাবিপত্তি, ট্রাউজার আর গেঞ্জি নেওয়া হয় নি। মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। নতুন করে শুরু করার কোনো মানে হয় না। মিথিলার এখনও শেষ হয় নি। বড় ব্যাগটা সে দখল করেছে। কিছু বলতেও পারছি, শেষমেষ কোনো উপায় না দেখে আবার মানবিক আবেদন করতে হল,
-মিথু
-হু
-এই মিথু...
-আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমার কানে সমস্যা আছে?
-মোটেই না?
-তাহলে মিথু মিথু করছিস কেন? বলে ফেল!
-ক্ষুদ্র পরিসরে একটা মানবিক আবেদন...
-কি?
-আমার ব্যাগে জায়গা নেই। ট্রাউজার গেঞ্জি গুলো তোর ব্যাগে নিতে পারবি?
-যদি না নেই?
এবার প্রচন্ড রাগ লাগছে, এত ভালো করে বললাম, তার পরেও শুনল না। কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে শুরু করলাম,
তখন বউ আমার পিছন থেকে ডাক দিল,
-কোনটা কোনটা নিব?
-তোর ইচ্ছে।
বলে চলে আসলাম। নিচে নামতে গিয়ে আবার রুমে উঁকি মারলাম, দেখি সে যত্নে সহকারে ট্রাউজার আর গেঞ্জি ভাঁজ করে তার ব্যাগে পুড়ে দিল।
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হলাম, মিথুও উঠে গেছে।তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পরতে হবে, সাড়ে ন’টায় ফ্লাইট। আকাশী রঙের শার্ট গায়ে দিতে যাবো এর মধ্যে মিথু বলল,
-তোর কালো রঙের শার্ট নেই?
-আছে। কেন?
-সেটা পর না! তোকে সুন্দর লাগবে।
মিথু এই কথা বলছে? ভাবতেই অবাক লাগছে! বলেছে যখন ড্রয়ার থেকে কালো শার্ট টা বের করে পরলাম। টাই হাতে নিয়েছি, নট বাঁধতে যাবো,
-দে আমি বেঁধে দিচ্ছি।
বাধ্য ছেলের মত কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। নট বাঁধা শেষ করে সে বলল,
-দেখ, তোকে অনেক সুন্দর লাগছে।
আমি বরাবর নিজের উপর উদাসীন টাইপ পাবলিক, তাই আয়না দেখতে ইচ্ছে হল না। একটু পরে বান্দা জেল আর চিরুনি নিয়ে এসে চুল্গুলোর একটা হেস্তনেস্ত করে দিল। যত সময় যাচ্ছে তত বেশি অবাক লাগছে। রুম থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালাম, পিছন থেকে মিথু ডাকল,
-অভ্র
-হুম বল।
-শাড়িটা একা পড়তে পারছি না, একটু হেল্প করবি?
-আমি?
-হ্যাঁ!
-পারি না তো।
-বেশি কিছু না। শুধু কুঁচি গুলো একটু ধরলেই হবে।
গেলাম, সাথে সাথে হাতে শাড়ীর কুঁচি ধরিয়ে দিল, সুদীর্ঘ ৯ মিনিটের চেষ্টার তার শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে সফল হলাম। সাজসজ্জা শেষ। নেহাৎ আমি কবি নই, হলে হয়ত ওর রুপ দেখে এখনই সাহিত্য রচনায় বসে যেতাম। প্রথম লক্ষ্য করলাম, ওর চোখে ভিন্ন রকম একটা মায়া আছে।
.
আব্বু আম্মুর দোয়া নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। গিয়ে শুনি ফ্লাইট ডিলে হবে একঘন্টার মত। কিছু করার নেই, ওয়েটিং রুমে বসে আছি তখন মিথু বলল,
-চল, আইসক্রিম খেয়ে আসি।
-ইচ্ছে করছে না।
-চল না।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হল, যেহেতু ফ্লাইট ডিলে হবে, তাই এত সময় বসে থাকার মানে হয় না। তবে একটু রাগী হলেও মিথুর মধ্যে বাচ্চামি অভ্যাগ গুলো এখনো রয়ে গেছে।
.
দেখতে দেখতে ডিপাচার টাইম হয়ে আসল। থাই এয়ারওয়েজ এর ফার্স্ট ক্লাস টিকিট। দীর্ঘ যাত্রা শেষে গিয়ে নামনাল থাই এয়ারপোর্টে। যেখান থেকে ট্যাক্সি যোগে সোজা Centra Grand Beach resort এ উঠলাম। অসাধারণ জায়গা। রিসোর্টের সামনে বিশাল এক সুইমিং পুল। আরেকটু সামনে বীচ। তারপর সু-বিশাল সমদ্র। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, প্রকৃতিও যেন তার রুপ আরো বেশি ঢেলে সাজিয়ে নিচ্ছে। সারাদিনের জার্নি তে খুব ক্লান্ত লাগছে। মিথু এসেই বিছানায় শুয়ে পরেছে। সে খেয়াল করে নি জায়গাটা এত সুন্দর। শাওয়ার নিয়ে বাইরে এসে দেখি মিথু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,
-যা ফ্রেস হয়ে নে।
-হ্যাঁ যাচ্ছি! আর শোন, তুই রেডি হয়ে নে, বীচে যাব।
-আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।
-কোনো কথা বলবি না।
চুপসে গেলাম, পাগলীটা যেহেতু বায়না ধরেছে কিছু করার নেই। ।
.
বীচে হাটছি, পাশে মিথিলা, একটু এগিয়ে সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দিলাম। সামনে বসার জায়গা, গিয়ে বসলাম, আলো আঁধারের অসাধারণ খেলা চলছে, বেশ লাগছে দেখতে। হঠাৎ বউ আমার বলে উঠল,
-জানিস, অনেক দিনের ইচ্ছে, alcohol খাব। কখন সাহস হয়ে উঠে নি। নিয়ে আসবি?
-এখনই খাবি?
-হুম!
.
মুখ ফুটে বলেছে আনতে গেলাম,আমার এই সবের উপর কোনো নেশা নেই তাই নিজের জন্য একটা ফ্রুট জুস নিলাম। ওর কাছে ফিরে গ্লাস টা হাতে দিয়ে আবার পাশে বসলাম।খেয়াল করলাম মিথিলা ঘাড়ে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে। নিজের কাছে একটু বিব্রত বোধ হচ্ছে। আশে-পাশে লোকজন কমে আসছে, রাতও হয়ে এল। উঠতে হবে। মিথিলা ঘুমিয়ে গেছে। ডাকবো কি না বুঝতে পারছি না, কিন্তু এভাবে তো বসে রাত কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। ডাক দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম কোলে করে রিসোর্টে নিয়ে যাব, উপায় না পেয়ে তাই করতে বাধ্য হলাম, কোলে তুলে নিলাম ওকে, হাঁটতে শুরু করলাম রিসোর্টের দিকে, আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। এ তো মহা মুসিবত, যে মেয়ে আমার সাথে ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না, সে ড্রিংস করে গলা ধরেছে, ঘুমে না থাকলে হয়ত আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলত। রুমে ফিরে খাটে শুইয়ে দিলাম, গুটিশুটি শুয়ে পড়ল। পাতলা একটা চাদর ওর গায়ে টেনে দিলাম। মুখের উপর কিছু চুল উড়ে এসেছে, সড়িয়ে দিলাম, ও অন্য পাশ ফিরল। আমি আর কি করব, সোফায় একটা বই নিয়ে শুয়ে পরলাম।
.
কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙ্গল মিথুর গলার চিল্লাপাল্লা শুনে,
-এই অভ্র, অভ্র! উঠবি নাকি পানি থেরাপি দিতে হবে?
-চোখ ডলতে ডলতে উঠলাম। কি হয়েছে?
-চল সমুদ্রে যাবো
-কোন দরকার নেই।
-চল না। না হলে আমি একা যাবো কিন্তু।
.
না গিয়ে উপায় নেই, পাগলিটা একা গিয়ে কি না কি করে বসে! সাথে যেতে হল, সে মহানন্দে নেমে গেছে, আমি হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছি, আমার থেকে একটু দূরে সে বাচ্চাদের মত লাফালাফি শুরু করেছে, সামনে দিকে যেতে নিষেধ করে আমি পাড়ে চলে আসলাম, দেখলাম সে আরো সামনে এগিয়ে গেল কিছুটা। যদিও তার পাশে আরো কয়েকজন ছিল।বড় একটা ঢেউ আসতে শুরু করল, কিছু বুঝে উঠার আগেই শুধু একটা চিৎকার শুনলাম...
-অভ্র...
.
মিথিলাকে দেখতে পাচ্ছি না, বুকের বা পাশ টায় মোচড় দিয়ে উঠল, ঘাম ছুটতে শুরু করেছে, আমি এগিয়ে যেতে চাইলাম, সাথে সাথে কিছু রক্ষী বাহিনীর সদস্য আমাকে খপ করে ধরে বসল, ডুবুরী দল নেমে পড়ল, মিথুর পাশে আরো ৪-৫ জন টুরিস্ট ছিল, প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে সবাইকে উদ্ধার করা গেলেও মিথিলার কোনো খবর মিলল না। বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে, সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করছি, তার কিছুক্ষন পর তাকেও উদ্ধার করে রিসোর্টের পাশে হসপিটালে ভর্তি করা হল!
.
সারাদিন ওর পাশে বসে থাকলাম, অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। বাড়িতে কিছু জানালাম না, খামখা তারা চিন্তা করবে। সব থেকে বড় কথা মিথু সুস্থ। রাত হয়ে এসেছে, সারাদিন কিছু খায়নি সে।নার্স এসে খাবার দিয়ে গেল, জানি একা খেতে পারলেও খাবে না, ভয় পেয়েছে অনেক বেশি, তাই খাইয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, খাবার মুখে নেওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করল,
-তুই কিছু খেয়েছিস?
ক্ষুধার কথাই ভুলেই গেছি, এখন যদি 'না' বলি তাহলে হয়ত ও খাবে না তাই মিথ্যে বলতে বাধ্য হলাম,
-হ্যাঁ খেয়েছি...
খাইয়ে দেওয়া শেষ হলে, ওর ঔষধ গুলোও বের করে খাইয়ে দিলাম। বিশ্রাম দরকার তাই শুয়ে পরতে বললাম।
-অভ্র
-বল
-আমার পাশে একটু থাকবি, খুব ভয় করছে...
-তুই ঘুমো, আমি পাশে আছি।
চেয়ার টা আরেকটু পাশে টেনে নিয়ে বসলাম, ও আমার হাতটা ধরে ঘুমিয়ে পরল। যত দিন যাচ্ছে পাগলীটা তত আপন করে নিচ্ছে...
.

সকাল হয়ে গেছে, পাগলীটা এখনও হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে, চেহারা খানিকটা শুকিয়ে গিয়েছে। যাবে না ই বা কেন? হয়ত আরো ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারত। সৃষ্টিকর্তার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া তেমন কিছু হয় নি, বেচারির জন্য খুব মায়া লাগছে। আজকে রিলিজ দিয়ে দেবার কথা। মিথিলা এখনও ঘুম থেকে জাগে নি। হাত ধরে ঘুমিয়েছে, কোথাও যেতে পারছি না। আমার মত ছন্নছাড়া মানুষ কারো জন্য চিন্তা করছে? ভাবা যায় না…
কিছু সময় পর সে নিজে জেগে উঠল,
-তুই রাতে ঘুমাস নি? [মিথিলা]
-না [আমি]
.
ডক্টর এসে আরেক বার রিপোর্ট দেখে আমাকে তার চেম্বারে ডাকল। ওর পাশ থেকে উঠে গিয়ে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলাম। তার ভাষ্য'র সারাংশ হল, চাইলে পেসেন্ট কে নিয়ে আজকে দুপুরের পরে চলে যেতে পারি। কেবিনে ফিরে মিথিলা কে জানালাম। সে বলল ঠিক আছে, নার্স এসে নাস্তা দিয়ে গেল, উঠে বসেছে পাগলিটা, ভাবলাম নিজে খেতে পারবে, আবার কি মনে করে যেন নিজে খাইয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, চেয়ার টেনে কাছে গিয়ে বসে খাইয়ে দিতে শুরু করলাম,
-তুই এত ভালো কেয়ার নিতে পারিস, জানতাম না তো!
ওর কথায় খুশি হব না রাগ করব বুঝতে পারছি না,
-কোনো কথা বলবি না, জানিস কত হেনেস্ত হতে হয়েছে? যদি ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যেত?
-তুই আছিস না? কিচ্ছু হবে না!
আর কিছু বললাম না, চুপ করে খাওয়ানো শেষ করে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসলাম। মিথু আবার ডাকল,
-অভ্র...কালকে যদি আমার কিছু একটা হয়ে যেত, কি করতি?
-আমি বেঁচে যেতাম...
হাঁসতে শুরু করেছে পাগলীটা, বাহ ওর হাসিটা তো বেশ সুন্দর।
-শোন, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে যা নিয়ে আয়!
-পারব না
-যা না, প্লীইইইইইইইইইইইইইইজ
এত করে যখন বলছে না গিয়ে পারলাম না, নিচে নেমে এলাম, আইসক্রিম পার্লার থেকে বেশ কয়েকটা আইসক্রিম নিয়ে আবার হসপিটালের দিকে রওনা দিলাম, রাস্তায় একটা ফুলের দোকানে কালো গোলাপ দেখে চোখ আঁটকে গেল, নেওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে নিয়ে নিলাম বেশ কয়েকটা। কেবিনে ফিরে দেখি আমার ফোন মিথুর হাতে, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কপালে দুঃখ আছে,
-আমার ফোন ধরেছিস কেন?
কোন কথা বলছে না, অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,
-তোর ফোনে ইহিতা নামের ফোল্ডারে একটা মেয়ের এতগুলো ছবি কেন?
কি বলব কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, কিছু একটা বলতে হবে,
-তাতে তোর কি?
-আমার কি মানে? আমার বরের ফোনে অন্য মেয়ের ছবি আমি সহ্য করব ভেবেছিস?
-সিরিয়াসলি? আচ্ছা, বাদ দে এইসব, অনেক বড় কাহিনি পরে একসময় বলব... এই নে তোর আইসক্রিম!
-ফুল কি ইহিতার জন্য কিনেছিস?
-কি যা তা শুরু করেছিস? তোর জন্য এনেছি [দিনে দুপুরে এত বড় মিথ্যা কিভাবে বললাম?]
-সত্যি?
-হুম
-জানিস আমার কালো গোলাপ অনেক পছন্দ...
-যাক, কিছু একটার সাথে মিলে আছে তাহলে...
.
কপাল ভালো ছিল আইসক্রিমের সাথে কালো গোলাপের সুবাধে এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। মিথুকে নিয়ে রিসোর্টে ফিরেছি, রুমে ফিরে সে আবার ঘুমিয়েছে, যদিও বেশি সময় না। উঠে আবার বায়না ধরল সে শপিং করতে যাবে। এ কি মুসীবত? সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারি নি, একটু ঘুমবো, তার কোনো উপার দেখতে পাচ্ছি না। কিছু করার নেই, তাই তৈরি হয়ে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম, সে তো মহা খুশি, দেখে মনে হবে না, গত কাল তার উপর দিয়ে কত বড় এক বিপদ চলে গেছে।
.
মার্কেটে গিয়ে, তার কেনা কাটার অবস্থা দেখে আমার অবস্থা, ছেড়ে দে বাপ কেঁদে বাঁচি, এইরকম হয়ে গেল। আমার দু-হাত ভর্তি ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে সে এটা ওটা কিনেই চলেছে। হুট করে সে এক শপে ঢুকে কি যেন খুঁজতে থাকে, আমি বার বার জিজ্ঞা করে যাচ্ছি, কি খুঁজছিস? তার কোনো সাড়া নেই। একটু সামনে গিয়ে সে দাঁড়ায়,
-অভ্র
-হু
-এদিকে আয়।
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
-কি হয়েছে?
-এই জ্যাকেট দুটো দেখ না
-গরমে মধ্যে তুই জ্যাকেট দিয়ে কি করবি?
-আরে, বোকা আমাদের দেশে তো শীত চলছে, গিয়ে লাগবে না? দেখ কেমন লাগে!
তাকিয়ে দেখি জ্যাকেটের একটা ছেলেদের আরেকটা মেয়েদের। একটা পিছে লেখা, The King এবং আরেকটা পিছনে The Queen! মনের অজান্তে একটু হেসে উঠলাম। আমার গুণ্ডি বউটা এত রোম্যান্টিক বাহ...
.
মার্কেট শেষ করে একটা রেন্টুরেন্টে বসলাম ডিনার করতে। খাবার অর্ডার করে আন মনে বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছি, এর মধ্যে মিথু ডাক দিল,
-অভ্র
-বল
-ঐ মেয়েটাকে দেখ।
ফোনের দিকে চেয়ে থেকে বললাম,
-কোনটা?
-আরে, ঐ যে আমাদের সামনের টেবলে।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে মাথা তুলে দেখি ইহিতা সাথে আবির ডিনার করছে। আকাশ থেকে পড়লাম। এই মেয়ের সাথে আমার গত ৬ বছর কোনো দেখা নাই। অনেক খুঁজে ক্লান্ত হয়ে প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, মিথুর কথায় বাস্তবে ফিরে আসলাম,
-এই মেয়ের ছবি তোর ফোনে আমি দেখেছি।
এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করলাম,
-আরে নাহ, তুই অন্য মেয়ের ছবি দেখেছিস,
-না, এই মেয়ের ছবিই আমি দেখেছে, ওর নাম ইহিতা? ঠিক?
হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম,
-হ্যাঁ
-এই মেয়ের সাথে তোর কি যেন একটা চক্কর ছিল এক সময়ে? ঠিক?
-হ্যাঁ।
-তাহলে ফুপ্পিকে জানাস নি কেন?
- সে এক ইতিহাস!
-তোর ইতিহাসের গুল্লি মারি, চল কথা বলে আসি!
-ইচ্ছে নেই
-কি বললি?
-বলেছি, ইচ্ছে করছে না!
মিথুও কেন জানি আর জোর করল না, খাবার চলে আসল, কেন যেন মুড টা চেঞ্জ হয়ে গেল। কোনো রকম খাবার শেষ করে মিথু কে নিয়ে রিসোর্টে চলে আসলাম।
.
রাত হয়ে গেছে অনেকটা! মিথু ঘুমোচ্ছে, আমি একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি বিশাল জলরাশির দিকে। ভাবছি ইহিতার কথা, মনের অজান্তে চোখ দিয়ে একফোটা জল চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল! হঠাৎ কে যেন কাঁধের উপর হাত রাখল, তাকিয়ে দেখি মিথু, কখন ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে চলে এসেছে খেয়াল করি নি!
-মন খারাপ? [মিথিলা]
-হুম
-অনেক ভালোবাসতি ইহিতাকে?
কিছু বললাম না। গিয়ে পাশা পাশি দুটো রকিং চেয়ারের একটা তে গা এলিয়ে দিলাম। মিথু পাশের চেয়ার টা তে এসে বসল।
-এই অভ্র
-বল
-কি হয়েছিল ওর সাথে?
-বাদ দে, ওর বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না!
-আচ্ছা, চল ঘুমাবি না? গত কাল ঘুমাস নি একটুও
উঠে গিয়ে খাটের একপাশে শুয়ে পড়লাম! সে এসে আরেক পাশে শুয়ে পড়ল! ঘুম আসছে না কোন মতে। পুরনো স্মৃতিগুলো নিয়ে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ নিজেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছে। মাথায় হাতের স্পর্শ পেলাম, মিথু পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে ঘুম চলে আসল।
.
সকালে বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম, আজ আর মিথিলা বিরক্ত করে নি, কি মনে করে উপরওয়ালা মালুম। উঠার সাথে সাথে দেখি বান্দা চায়ের কাপ নিয়ে হাজির,
-শুভ সকাল
-আজ এত ভালো হয়ে গেলি?
-আমি বরাবরই ভালো
একটু হাসলাম। চা শেষ করে ফ্রেস হয়ে মিথু কে নিয়ে নিজেই বীচে ঘুরতে বেরলাম।পাগলীটা আজকে ইচ্ছে করেই হাত ধরে হাটছে! ভালো লাগছে, চারিদিকের পরিবেশ টা অসাধারণ। একটু এগিয়ে গিয়ে বসলাম দুজনে, সামনে সরু কিছুটা রাস্তা, আনমনে তাকিয়ে ছিলাম নীল সমুদ্রের দিকে। হঠাৎ কে যেন বলল,
-আরে অভ্র না?
বামে ঘুরে দেখি আবির, এক সময়কার পরিচিত ভাই,
-জ্বি ভাইয়া, কেমন আছেন?
-হ্যাঁ ভালো, কবে এসেছ?
-এইত অল্প কয়েকদিন হল। আপনি কি এখানে আছেন?
-হ্যাঁ। আসলে দেশে যাওয়া হয় না অনেক দিন তাই তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না!
-ওহ, ভাইয়া পরিচয় করি দেই, এই হচ্ছে আমার মিসেস!
-মিথু, আবির ভাই!
টুকটাক কথা বলছিলাম হঠাৎ আবির ভাইয়া বলল, চল আমাদের বাসায়, কথা শেষ করার আগেই কোথা থেকে যেন ইহিতা চলে আসল,
-এই আবির [ইহিতা]
-আরে, ইহিতা, এসো! দেখ অভ্র এসেছে তার মিসেস কে নিয়ে, হানিমুনে!
-অভ্র, কেমন আছিস?
আবিরের একটা কল আসায় সে একটু পাশে গিয়ে কথা বলতে থাকে,
-যেভাবে দেখতে চেয়েছিলি...
চুপ করে যায় ইহিতা, নিরবতা ভাঙ্গে মিথু,
-আপনি ইহিতা আপু? তাই না?
মৃদু হেসে উত্তর দেয় সে,
-হ্যাঁ।
-আপনার কথা আমাকে বলে নি এই ফাজিল টা, আমি ওর ফোন থেকে বের করেছি।
মিথু একটা বিজয়ী হাসি দিয়ে থেমে গেল, আমি কোন কথা না বলে চুপ করে থাকলাম। ইহিতা আবার বলল,
-তো, বিয়ে করলি কবে?
-এইত কিছু দিন
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, গলা কেঁপে উঠছে, এর মধ্যে আবির ভাইয়ের কথা শেষ হয়ে যায়, তাকে একটু ব্যস্ত মনে হল, বাসার ঠিকানা দিয়ে ইহিতাকে নিয়ে চলে যায়।
আমি মিথুকে নিয়ে রওনা দিলাম রিসোর্টের দিকে। আসার সময় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-মিথু, আমাদের গল্পটা চাইলে অন্য রকম হতে পারত। তাই না?
বউ আমার একটু মুচকি হাসল শুধু...

~গত দিনের ঘটনার পর, নিজের কাছে কিছুটা বিব্রত লাগছে, কখনও ভাবী নি ইহিতার সাথে আবার দেখা হতে পারে। রাতে ভালো ঘুম হয় নি, ঘুমোতে হবে। বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম, মিথু রেডি হয়ে কোথায় যেন বের হবে আয়োজন করছে, ভাবলাম কপাল হয়ত আজকেও পুড়েছে, ঠিকমত ঘুমোনোর সুযোগ পাচ্ছি না। চোখ লেগে আসতে শুরু করেছে, তখন মিথু ডাকল,
-অভ্র, ঘুমিয়েছিস?
-হু
-কি হু হু? শোন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ঘন্টা খানের মধ্যে ফিরব। তুই ঘুমো!
-হু
-আর শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে
ঘুমের মধ্যে আর কিছু বলেছিলাম কি না মনে পড়ছে না,
গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম...
.
আজকাল আমি দিবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, দেখলাম আমি আর মিথু কোনো এক পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছে, হঠাৎ সে আমার হাত ফসকে এক খাঁদে পরে গেল। শুধু একবার তার চিৎকার শুনলাম, তারপর চারিদিক নিস্তদ্ধ হয়ে আসল, আমিও অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে, চেহারা ঝাপসা, ঠিকমত বুঝতে পারছি না। এইটুকু দেখার পর আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলাম না, লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, হার্টবির্ট অনেকটা বেড়ে গেছে। পাশে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। কত সময় ঘুমিয়েছি? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় দু’ঘন্টার অধিক হয়ে গেছে। মিথু বলে গেল কোথায় যেন যাবে। সে এখনো ফিরে আসে নি। চিন্তা লাগছে, ফোন দিলাম,
-হ্যালো মিথু! কোথায় তুই?
-এইত এসে পরেছি, রিসোর্টের পাশেই।
.
আর কিছু বললাম না, ফোন কেটে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম শাওয়ার নিতে । বেশ লম্বা সময় শাওয়ার নিয়ে বের হলাম সাথে সাথে কলিং বেলে চাপ পড়ল। ভাবলাম হয়ত মিথু চলে এসেছে। রুমের দরজা খুলে দিয়ে বললাম,
-কোথায় গিয়েছিলি হ্যাঁ? এত লেট হল কেন ফিরতে?
এবার উপরে তাকালাম, আমার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল, মিথু একা না, তার সাথে ইহিতাও দরজার সামনে দাঁড়ানো...
.
রিসোর্টের বারান্দায় বসে আছি, পিন পতন নিরবতা, কেউ কোনো কথা বলছে না, আমার আসলে রাগ করা উচিত কি না বুঝে উঠার চেষ্টা করছি, মিথিলা নিরবতা ভাঙ্গে,
-অভ্র, কফি খাবি? ইহিতা তুমি?
আমি এবার মিথুর দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকালাম। সে হুট করে কফি আনতে বেড়িয়ে গেল। রুমে আমি আর ইহিতা, আমি বুঝে উঠতে পারছি না, মিথিলা আমার বউ হয়ে ইহিতাকে কেন বাসায় নিয়ে আসল? আর এখন একা রেখে কেন বাইরে গেল? আসলে ও চাচ্ছে টা কি? ইহিতা এবার কথা বলতে শুরু করল,
-কেমন আছিস অভ্র?
-ভালো থাকার কথা ছিল...
-তোর পেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যাস টা এখনো রয়ে গেল?
-অনেক অভ্যাস এখনো আগের মতই আছে। বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন হয় নি বা করার চেষ্টা করি নি!
-বিয়েটা কি ইচ্ছে করে করেছিস?
-তোর কি তাই মনে হয়?
-এখন আর আগের মত কিছু মনে করতে ইচ্ছে হয় না রে!
.
কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, তার আগেই মিথু কফি নিয়ে হাজির। কফি রেখে সে আবার কোথায় যেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে,
-কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-এক মিনিট অপেক্ষা কর।
সে রুমে চলে গেল। নিজের ব্যাগ বের করে কি যেন খুজতে লাগল, আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, কি যেন একটা বের করে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসল।
-হ্যাঁ কি যেন বলছিলি অভ্র?
কিছু না বলে ওর হাতের দিকে লক্ষ্য করলাম। একি? আমার ডায়েরী ওর হাতে কেন? এই ডায়েরী তো গত ৬বছর আমি নিজেই খুলি নি।
-মিথু, এটা তোর কাছে কেন?
-কোনটা??
-ডায়েরীটা
-ও এইটা? তোর ওয়ারড্রপ থেকে জামাকাপড় সড়াতে গিয়ে পেয়ে ছিলাম।
-ধরেছিস কেন?
-কি বলিস? আমি না তোর স্ত্রী? এইটুকু অধিকার কি আমি সংরক্ষণ করি না?
.
কিছু বললাম না। চুপসে গেলাম। যেহেতু ডায়েরী মিথিলার হাতে সুতরাং ইহিতা সম্পর্কে কিছুই তার অজানা থাকার কথা না! এবার ইহিতা শুরু করল,
-আচ্ছা, তোমাদের সম্পর্ক এই রকম কেন?মনে হয় ইঁদুর বিড়ালের মত সারাদিন ঝগড়া কর।
আমি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, তার আগেই মিথিলা জবাব দিল,
-আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না এই গবেট টাকে বিয়ে করার। কিন্তু ফ্যামিলি হুট করে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের ৪ ঘন্টা আগে শুনলাম আজকে আমার বিয়ে। ব্যাপারটা অসাধারণ না?
.
ইহিতা একটু হাসল। এবার আমি শুরু করলাম,
-আমি কি তোকে বিয়ে করার জন্য বসে ছিলাম? তুই তো ৪ ঘন্টা সময় পেয়েছিস, আর আমি তো বিয়ের আসরে গিয়ে শুনেছি আমার বিয়ে।
ইহিতা এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসিটা আগের মতই আছে। মিথু আবার শুরু করল,
-আচ্ছা বাদ দে, ডায়েরীতে তুই ১১ পৃষ্ঠার পর আর কিছু লেখিস নি! কেন?
চুপ করে থাকলাম। আসলে আমি কখনো চাইনি এই ডায়েরী কারো হাতে পৌঁছুক, আর পড়া তো দূরে থাক। মিথুর কথার ভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, সে শুধু ডায়েরী পড়ে নি, সকল কাহিনি আদি অন্ত বুঝে ফেলেছে। আর সেই সুবাদে আজকে ইহিতা আবার সামনে হাজির। কি দরকার ছিল সেদিন রেস্টুরেন্টে ডিনার করা, কি দরকার ছিল আবির ভাইয়ের সাথে পরের দিন দেখা হওয়া। দেখা হল ভালো, বাসার ঠিকানা কেন দিল? আর আমিই বা কেন সেটা মিথুর কাছে রেখে দিলাম? কথা গুলো মনে পরলে নিজের মাথা দেওয়ালের সাথে ঠুকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মিথুর কথায় আবার বাস্তবে ফিরে আসলাম,
-ইহিতা, ডায়েরীটা তুমি দিয়েছিলে এই বানরটাকে?
-হ্যাঁ
-কিন্তু দেখছ? গবেট টা শুধু মাত্র ১১ পৃষ্ঠা লিখে আর মনে হয় ছুঁয়েও দেখে নি।
.
ইহিতা এবার বলতে শুরু করে,
-জানো মিথিলা, অভ্র আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। অনেকটা সময় এক সাথে পার করেছি। হাইস্কুল, কলেজ ইভেন ভার্সিটিরও কিছুটা সময়। আমার থেকে ভালো মনে হয় পাগল টাকে কেউ চিনবে না। ওর পছন্দ, অপছন্দ, রাগ, অভিমান,প্রতিটি জিনিস খুব কাছ থেকে দেখেছি। জানি না সেই সময়ের মধ্যে অভ্র কখন এত কাছে চলে এসেছে। আমিও বুঝতে পারি নি, অনেক চমৎকার সময় একত্রে পার করেছি।
-জানি ইহিতা। তোমাদের গল্পটা চাইলে ভিন্ন রকম হতে পারত।
-আসলে ততটা সহজ ছিল, আমি আবিব কে দেওয়া কথা কোনো মতেই ফেলতে পারতাম না। আর অভ্রর আশে পাশে থাকলে কোন দিন আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তাই পালিয়ে এসেছি অনেক দূরে। জানি আমাকে অনেক খুঁজেছে সে। কষ্টও পেয়েছে নেহাৎ কম নয়। আমি নিরুপায় ছিলাম।
.
ইহিতার গলা কেঁপে উঠছে কথা বলতে গিয়ে, তাই আর সামনে এগুতে চাইলাম না।
-আচ্ছা বাদ দে এইসব। তারপর ইহিতা, বিয়ে করলি কবে?
-এইত, ৬মাসের মত। দেশ থেকে আসার পর ইতালী ছিলাম মামার কাছে। অনেক দিন আবিরের সাথে যোগাযোগও করিনি। তারপর হঠাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
-ভালো তো।
মিথু, আবার কোথায় যেন যেতে উঠে গেল, এবার সে একা নয়, ইহিতাও উঠল তার সাথে, আমি ভাবলাম হয়ত ইহিতা তাড়া আছে তাই ওর চলে যেতে হবে। কিন্তু মিথু কোথায় গেল? একা বসে থাকলাম বারান্দায়। একটু পরে দেখি দুজন আবার ফিরে এসেছে, উভয়ের মুখে বিজয়ীর হাসি। একটু সামনে এগিয়ে হামলে পড়ল আমার উপর। ইহিতার হাতে কেক, মিথু পার্টি স্পে দিয়ে আমাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, আজকে আমার জন্মদিন! আসলে এই সব ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এইজন্য তাহলে মিথিলা বলেছিল আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে? আর ইহিতার সাথে আবার দেখা হওয়ার চাইতে বড় সাইপ্রাইজ আর কি ই বা হতে পারে? মিথু চিৎকার করে বলে উঠল,
-হ্যাপি বার্থডে অভ্র...
ইহিতাও সাথে যোগ দিল। ভালো লাগছে, মিথু এত খবর নিয়েছে তাহলে? পিচ্চি টা তাহলে আসলেই বড় হয়ে গেল?
কেক কাটার পর সবাই একত্রে লাঞ্চ করার জন্য বের হলাম। লাঞ্চ শেষ করে অনেকটা সময় বীচে ঘুরলাম। বিকেল গড়িয়ে গোধুলি হয়ে এসেছে, রিসোর্টে ফিরলামও এক সাথে। এবার ইহিতাকে যেতে হবে। অনেক কথা বলার ছিল তাকে, তব কেন জানি আর ইচ্ছে করল না। উঠে দাঁড়িয়েছে সে,
-অভ্র
-হু
-একটা কথা রাখবি?
-কি?
-ডায়েরী টা আমাকে দিবি?
মৃদু হাসলাম। যার জিনিস তার কাছে থাকা ভালো। মিথুর কাছ থেকে ডায়েরী নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিলাম। কেন যেন চোখটা ভিজে আসতে চাইছে বড্ড জোর করে। বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। আর কথা না বলে ইহিতা পা বাড়ল চলে যাবার জন্য, যাবার আগে মিথিলাকে শুধু একটা কথা বলে গিয়েছিল,
-পাগলটাকে আগলে রেখ...
.
বারান্দায় আমার গিয়ে দাড়ালাম। রিসোর্টের সামনের সরু রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে ইহিতা। বাতাসে তার চুল উড়ছে, হয়ত এই শেষ বার, আর কোনো দিন দেখা হবে না তার সাথে। সর্ব শেষ স্মৃতিটুকুও ফিরিয়ে দিলাম। মিথিলা খুব কাছে এসে দাঁড়াল। একটু হাসি দিয়ে বললাম,
-কিছু ভালোবাসার সমাপ্তি অপূর্ণ থেকে যায়, তাই না?
-হ্যাঁ, তবে সেটুকু পূর্ন করার জন্য আমি আছি...

~গত দিনের ঘটনার পর, নিজের কাছে কিছুটা বিব্রত লাগছে, কখনও ভাবী নি ইহিতার সাথে আবার দেখা হতে পারে। রাতে ভালো ঘুম হয় নি, ঘুমোতে হবে। বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম, মিথু রেডি হয়ে কোথায় যেন বের হবে আয়োজন করছে, ভাবলাম কপাল হয়ত আজকেও পুড়েছে, ঠিকমত ঘুমোনোর সুযোগ পাচ্ছি না। চোখ লেগে আসতে শুরু করেছে, তখন মিথু ডাকল,
-অভ্র, ঘুমিয়েছিস?
-হু
-কি হু হু? শোন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ঘন্টা খানের মধ্যে ফিরব। তুই ঘুমো!
-হু
-আর শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে
ঘুমের মধ্যে আর কিছু বলেছিলাম কি না মনে পড়ছে না,
গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম...
.
আজকাল আমি দিবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, দেখলাম আমি আর মিথু কোনো এক পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছে, হঠাৎ সে আমার হাত ফসকে এক খাঁদে পরে গেল। শুধু একবার তার চিৎকার শুনলাম, তারপর চারিদিক নিস্তদ্ধ হয়ে আসল, আমিও অতলে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে, চেহারা ঝাপসা, ঠিকমত বুঝতে পারছি না। এইটুকু দেখার পর আর ঘুমিয়ে থাকতে পারলাম না, লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, হার্টবির্ট অনেকটা বেড়ে গেছে। পাশে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। কত সময় ঘুমিয়েছি? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় দু’ঘন্টার অধিক হয়ে গেছে। মিথু বলে গেল কোথায় যেন যাবে। সে এখনো ফিরে আসে নি। চিন্তা লাগছে, ফোন দিলাম,
-হ্যালো মিথু! কোথায় তুই?
-এইত এসে পরেছি, রিসোর্টের পাশেই।
.
আর কিছু বললাম না, ফোন কেটে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম শাওয়ার নিতে । বেশ লম্বা সময় শাওয়ার নিয়ে বের হলাম সাথে সাথে কলিং বেলে চাপ পড়ল। ভাবলাম হয়ত মিথু চলে এসেছে। রুমের দরজা খুলে দিয়ে বললাম,
-কোথায় গিয়েছিলি হ্যাঁ? এত লেট হল কেন ফিরতে?
এবার উপরে তাকালাম, আমার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল, মিথু একা না, তার সাথে ইহিতাও দরজার সামনে দাঁড়ানো...
.
রিসোর্টের বারান্দায় বসে আছি, পিন পতন নিরবতা, কেউ কোনো কথা বলছে না, আমার আসলে রাগ করা উচিত কি না বুঝে উঠার চেষ্টা করছি, মিথিলা নিরবতা ভাঙ্গে,
-অভ্র, কফি খাবি? ইহিতা তুমি?
আমি এবার মিথুর দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকালাম। সে হুট করে কফি আনতে বেড়িয়ে গেল। রুমে আমি আর ইহিতা, আমি বুঝে উঠতে পারছি না, মিথিলা আমার বউ হয়ে ইহিতাকে কেন বাসায় নিয়ে আসল? আর এখন একা রেখে কেন বাইরে গেল? আসলে ও চাচ্ছে টা কি? ইহিতা এবার কথা বলতে শুরু করল,
-কেমন আছিস অভ্র?
-ভালো থাকার কথা ছিল...
-তোর পেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যাস টা এখনো রয়ে গেল?
-অনেক অভ্যাস এখনো আগের মতই আছে। বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন হয় নি বা করার চেষ্টা করি নি!
-বিয়েটা কি ইচ্ছে করে করেছিস?
-তোর কি তাই মনে হয়?
-এখন আর আগের মত কিছু মনে করতে ইচ্ছে হয় না রে!
.
কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, তার আগেই মিথু কফি নিয়ে হাজির। কফি রেখে সে আবার কোথায় যেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে,
-কোথায় যাচ্ছিস তুই?
-এক মিনিট অপেক্ষা কর।
সে রুমে চলে গেল। নিজের ব্যাগ বের করে কি যেন খুজতে লাগল, আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছি, কি যেন একটা বের করে আবার আমাদের কাছে ফিরে আসল।
-হ্যাঁ কি যেন বলছিলি অভ্র?
কিছু না বলে ওর হাতের দিকে লক্ষ্য করলাম। একি? আমার ডায়েরী ওর হাতে কেন? এই ডায়েরী তো গত ৬বছর আমি নিজেই খুলি নি।
-মিথু, এটা তোর কাছে কেন?
-কোনটা??
-ডায়েরীটা
-ও এইটা? তোর ওয়ারড্রপ থেকে জামাকাপড় সড়াতে গিয়ে পেয়ে ছিলাম।
-ধরেছিস কেন?
-কি বলিস? আমি না তোর স্ত্রী? এইটুকু অধিকার কি আমি সংরক্ষণ করি না?
.
কিছু বললাম না। চুপসে গেলাম। যেহেতু ডায়েরী মিথিলার হাতে সুতরাং ইহিতা সম্পর্কে কিছুই তার অজানা থাকার কথা না! এবার ইহিতা শুরু করল,
-আচ্ছা, তোমাদের সম্পর্ক এই রকম কেন?মনে হয় ইঁদুর বিড়ালের মত সারাদিন ঝগড়া কর।
আমি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, তার আগেই মিথিলা জবাব দিল,
-আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না এই গবেট টাকে বিয়ে করার। কিন্তু ফ্যামিলি হুট করে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের ৪ ঘন্টা আগে শুনলাম আজকে আমার বিয়ে। ব্যাপারটা অসাধারণ না?
.
ইহিতা একটু হাসল। এবার আমি শুরু করলাম,
-আমি কি তোকে বিয়ে করার জন্য বসে ছিলাম? তুই তো ৪ ঘন্টা সময় পেয়েছিস, আর আমি তো বিয়ের আসরে গিয়ে শুনেছি আমার বিয়ে।
ইহিতা এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসিটা আগের মতই আছে। মিথু আবার শুরু করল,
-আচ্ছা বাদ দে, ডায়েরীতে তুই ১১ পৃষ্ঠার পর আর কিছু লেখিস নি! কেন?
চুপ করে থাকলাম। আসলে আমি কখনো চাইনি এই ডায়েরী কারো হাতে পৌঁছুক, আর পড়া তো দূরে থাক। মিথুর কথার ভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, সে শুধু ডায়েরী পড়ে নি, সকল কাহিনি আদি অন্ত বুঝে ফেলেছে। আর সেই সুবাদে আজকে ইহিতা আবার সামনে হাজির। কি দরকার ছিল সেদিন রেস্টুরেন্টে ডিনার করা, কি দরকার ছিল আবির ভাইয়ের সাথে পরের দিন দেখা হওয়া। দেখা হল ভালো, বাসার ঠিকানা কেন দিল? আর আমিই বা কেন সেটা মিথুর কাছে রেখে দিলাম? কথা গুলো মনে পরলে নিজের মাথা দেওয়ালের সাথে ঠুকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মিথুর কথায় আবার বাস্তবে ফিরে আসলাম,
-ইহিতা, ডায়েরীটা তুমি দিয়েছিলে এই বানরটাকে?
-হ্যাঁ
-কিন্তু দেখছ? গবেট টা শুধু মাত্র ১১ পৃষ্ঠা লিখে আর মনে হয় ছুঁয়েও দেখে নি।
.
ইহিতা এবার বলতে শুরু করে,
-জানো মিথিলা, অভ্র আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। অনেকটা সময় এক সাথে পার করেছি। হাইস্কুল, কলেজ ইভেন ভার্সিটিরও কিছুটা সময়। আমার থেকে ভালো মনে হয় পাগল টাকে কেউ চিনবে না। ওর পছন্দ, অপছন্দ, রাগ, অভিমান,প্রতিটি জিনিস খুব কাছ থেকে দেখেছি। জানি না সেই সময়ের মধ্যে অভ্র কখন এত কাছে চলে এসেছে। আমিও বুঝতে পারি নি, অনেক চমৎকার সময় একত্রে পার করেছি।
-জানি ইহিতা। তোমাদের গল্পটা চাইলে ভিন্ন রকম হতে পারত।
-আসলে ততটা সহজ ছিল, আমি আবিব কে দেওয়া কথা কোনো মতেই ফেলতে পারতাম না। আর অভ্রর আশে পাশে থাকলে কোন দিন আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তাই পালিয়ে এসেছি অনেক দূরে। জানি আমাকে অনেক খুঁজেছে সে। কষ্টও পেয়েছে নেহাৎ কম নয়। আমি নিরুপায় ছিলাম।
.
ইহিতার গলা কেঁপে উঠছে কথা বলতে গিয়ে, তাই আর সামনে এগুতে চাইলাম না।
-আচ্ছা বাদ দে এইসব। তারপর ইহিতা, বিয়ে করলি কবে?
-এইত, ৬মাসের মত। দেশ থেকে আসার পর ইতালী ছিলাম মামার কাছে। অনেক দিন আবিরের সাথে যোগাযোগও করিনি। তারপর হঠাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
-ভালো তো।
মিথু, আবার কোথায় যেন যেতে উঠে গেল, এবার সে একা নয়, ইহিতাও উঠল তার সাথে, আমি ভাবলাম হয়ত ইহিতা তাড়া আছে তাই ওর চলে যেতে হবে। কিন্তু মিথু কোথায় গেল? একা বসে থাকলাম বারান্দায়। একটু পরে দেখি দুজন আবার ফিরে এসেছে, উভয়ের মুখে বিজয়ীর হাসি। একটু সামনে এগিয়ে হামলে পড়ল আমার উপর। ইহিতার হাতে কেক, মিথু পার্টি স্পে দিয়ে আমাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, আজকে আমার জন্মদিন! আসলে এই সব ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এইজন্য তাহলে মিথিলা বলেছিল আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে? আর ইহিতার সাথে আবার দেখা হওয়ার চাইতে বড় সাইপ্রাইজ আর কি ই বা হতে পারে? মিথু চিৎকার করে বলে উঠল,
-হ্যাপি বার্থডে অভ্র...
ইহিতাও সাথে যোগ দিল। ভালো লাগছে, মিথু এত খবর নিয়েছে তাহলে? পিচ্চি টা তাহলে আসলেই বড় হয়ে গেল?
কেক কাটার পর সবাই একত্রে লাঞ্চ করার জন্য বের হলাম। লাঞ্চ শেষ করে অনেকটা সময় বীচে ঘুরলাম। বিকেল গড়িয়ে গোধুলি হয়ে এসেছে, রিসোর্টে ফিরলামও এক সাথে। এবার ইহিতাকে যেতে হবে। অনেক কথা বলার ছিল তাকে, তব কেন জানি আর ইচ্ছে করল না। উঠে দাঁড়িয়েছে সে,
-অভ্র
-হু
-একটা কথা রাখবি?
-কি?
-ডায়েরী টা আমাকে দিবি?
মৃদু হাসলাম। যার জিনিস তার কাছে থাকা ভালো। মিথুর কাছ থেকে ডায়েরী নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিলাম। কেন যেন চোখটা ভিজে আসতে চাইছে বড্ড জোর করে। বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। আর কথা না বলে ইহিতা পা বাড়ল চলে যাবার জন্য, যাবার আগে মিথিলাকে শুধু একটা কথা বলে গিয়েছিল,
-পাগলটাকে আগলে রেখ...
.
বারান্দায় আমার গিয়ে দাড়ালাম। রিসোর্টের সামনের সরু রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে ইহিতা। বাতাসে তার চুল উড়ছে, হয়ত এই শেষ বার, আর কোনো দিন দেখা হবে না তার সাথে। সর্ব শেষ স্মৃতিটুকুও ফিরিয়ে দিলাম। মিথিলা খুব কাছে এসে দাঁড়াল। একটু হাসি দিয়ে বললাম,
-কিছু ভালোবাসার সমাপ্তি অপূর্ণ থেকে যায়, তাই না?
-হ্যাঁ, তবে সেটুকু পূর্ন করার জন্য আমি আছি...

.
~গত রাত টা স্বপ্নের মত ছিল। মিথিলা এত তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসবে ভাবতে পারি নি। সকালের আলো ফুটেছে। সে আমাকে কোলবালিশ বানিয়ে বুকে মাথা রেখে এখনো ঘুমিয়ে আছে,
-মিথু
-হু
-সকাল হয়েছে তো। ওঠ না...
-ইচ্ছে করছে না!
-কেন?
-জানি না। আর শোন, তুই দেশে ফিরে Gym এর ধারে কাছেও যাবি না।
-কিহ? কেন?
-আমি রান্না করব, তুই খেয়ে-দেয়ে কুমড়ো পটাস হয়ে যাবি, তারপর তোকে আমি কোলবালিশের সাথে মাথার বালিশ বানিয়ে ঘুমবো।
-সবাই চায় তার বরের ফিটনেস থাকুক, আর তুই চাস কুমড়ো পটাস হই? হে উপরওয়ালা কি বউ দিয়েছ?
-কেন গো? তুমি কি ফিট থেকে অন্য মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করবে?
-করলে কি বিশেষ সমস্যা আছে?
-অন্য কারো সাথে যদি দেখেছি না, ঘুসি মেরে তোর নাক ফাটিয়ে ফেলব!
-হা হা, তুই আসলেই আমার পিচ্চি বউ...
মিথু কিছু না বলে আমাকে আরেকটু জড়িয়ে ধরল।
.
অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, এখন না উঠলে হচ্ছে না, চা পর্যন্ত খাওয়া হয় নি। তাই উঠে পড়লাম মিথু এখনও বেডে শুয়ে আছে। আমি গিয়ে ফ্রেস হয়ে বের হয়ে দেখি, সে ওঠার নামই নিচ্ছে না, ওদিকে তার ফোন বেজে যাচ্ছে,
-মিথু, তোর ফোন
-ধরে দেখ তো কে।
ওর ফোন হাতের নিয়ে দেখি, আমার শ্বাশুড়ী ফোন দিয়েছেন,
-হ্যালো মিথু!
-না মামী, অভ্র
-কেমন আছিস বাবা?
-ভালো আপনারা?
-এইত আছি। কেমন কাটছে দিন?
-ভালো। আপনার মেয়ের যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছি
-কেন বাবা, কি হয়েছে?
-ওর বাচ্চামো স্বভাবগুলোর জন্য...
-ও তো এমনই...
-পাগলীটা কোথায়?
-এখনো ঘুমোচ্ছে!
মিথুকে জোর করে উঠিয়ে বসালাম, ফোনটা ওর কানের কাছের ধরলাম,
-কি রে মা, কেমন আছিস?
-ভালো মা। তোমরা?
-ভালো আছি।
-দেশে ফিরবি কবে তোরা?
-খুব তাড়াতাড়ি।
-কেমন লাগছে জায়গাটা?
-খুব ভালো, তবে তোমাদের অভ্র সেদিন কি করেছে জান?
-কি করেছে?
সেড়েছে, এই কথা যদি তারা শুনে কপালে দুঃখ আছে তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। তাই ফোন তার কাছ থেকে নিয়ে,
-মামী, আপনার মেয়ে এখনো বিছানা থেকে উঠে নি। কি বলছে না বলছে তার কোন ঠিক নেই। আচ্ছা পরে ফোন দিব
বলে রেখে দিলাম,
-মিথু, তুই এই কথা মামীকে বলতে যাচ্ছিলি কেন?
-তোর কি করব? আমি দেশে ফিরে ফুপ্পিকে বলব
-পাগল হয়েছিস? যাহ্‌ বলিস তুই তোর শ্বাশুড়িকে। এখন ওঠ ঘুরে আসি...
ঠেলে তাকে ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে পাঠালাম, সোফায় গিয়ে মাত্র বসেছি, এর মধ্যে তার ডাক আসল,
-অভ্র
-কি হয়েছে আবার?
-আমার টাওয়াল টা দিয়ে যা তো।
নাহ, একে নিয়ে আর পারা যায় না। একটা কাজ যদি ঠিক মত করতে পারত, টাওয়াল নিয়ে তার কাছে গেলাম,
-এই নে তোর টাওয়াল।
সে টাওয়াল সমেত আমাকেও ভিতরে টেনে নিল...
.
আসাধারণ সময় কাটছে, কোনোদিন ভাবতে পারি নি আমার মত ছন্নছাড়া মানুষের জীবনটা মুহূর্তের মধ্যে পালটে যেতে পারে। তবে সব সময় ভয় হয়, কেন জানি না, আমার কপালে সুখ নামক জিনিট টা বেশি দিন স্থায়ী হয় না... তবে মিথু আসার পর থেকে সব কিছু ভালো হচ্ছে, ইহিতার সাথে দেখা, দুষ্ট মিস্টি খুনসুটি, আর নিঃসার্থ অনেকটা ভালোবাসা। আশা করি সে পারবে আমাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিতে।
সকালে আর বেড়নো হল না। তাই লাঞ্চ শেষ করে বিকেলে বীচ থেকে খানিকটা সামনে ঘুরতে বের হলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ ফোন বেজে উঠল, স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি অচেনা নম্বার। প্রথম বার না ধরে পকেটে রেখে দিলাম, আবার একই নম্বর থেকে ফোন আসল, একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধরলাম,
-হ্যালো।
-অভ্র বলছিলে?
-জ্বী, কে বলছিলেন প্লীজ?
-আমি আবির ভাইয়া।
-ওহ, ভাইয়া। আপনি আমার নম্বার কোথায় পেলেন?
-তোমাদের রিসোর্টে গিয়েছিলাম, দেখলাম তোমরা নেই পরে রিসিপশন থেকে নিয়েছি।
-কোনো দরকার ভাইয়া?
-তোমরা কোথায় আছ এখন?
-একটু বাইরে এসেছিলাম।
জায়গার নামটা বললাম, আবির ভাইয়া কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে বলল।
পাশের একটি কফি শপে ঢুকে কফি অর্ডার করে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটু পরে সে গাড়ি নিয়ে হাজির। শপে আসল,
-কি অভ্র, মিথিলা, কেমন যাচ্ছে? আশা করি ভালোই চলছে সব কিছু!
-জ্বি ভাইয়া ভাল। হঠাৎ জরুরী ভাবে ডাকলেন?
-আসলে, আজকে ইহিতার জন্মদিন। এখানে তো ওর তেমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। আর আমাদের বিয়ের পরে এই প্রথম জন্মদিন। যদি একদম কেউই না থাকে হয়ত ওর খারাপ লাগবে। আর ব্যস্ততার কারণে খুব বেশি সময় থাকতে পারি না ওর পাশে। তাই আমি চাচ্ছিলাম তুমি আর মিথিলা যদি আজকে আমাদের বাসায় আসতে, হয়ত ইহিতার ভালো লাগত।
-আসলে ভাইয়া,
আমার কথা শেষ করার আগে, মিথু জবাব দিল,
-অবশ্যই...
ভেবেছিলাম কোনো ভাবে পাশ কাটিয়ে যাব। আমি চাচ্চিলাম না আবার ইহিতার সাথে আর কোনদিন দেখা হোক। সবে মাত্র মিথুকে আপন করতে শুরু করেছি। নিয়তি আমার সাথে কি খেলা শুরু করেছে? অনিচ্ছা স্বর্ত্বেও যেতে হবে।
আবির ভাইয়া তার গাড়িতে করে আমাদের সাথে নিয়ে তার বাসার দিকে রওনা দিল। আমার মুড টা পরিবর্তন হয়ে গেল। আবির ভাইয়া বলল, বাসা বেশি দূরে নয়। তাই চুপ করে বসে থাকলাম। মিথু আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-অভ্র, ইহিতার জন্য কিছু একটা নেওয়া দরকার না?
কথা শেষ করার আগে সে আবির ভাইকে গাড়ী পার্ক করতে বলল, কারণ জানতে চাইলে বলল, একটু দরকার আছে,
গাড়িত থেকে নেমে সোজা গিফট শপের দিকে হাটা ধরল, আমিও তার পিছে পিছে গেলাম, আবির ভাইয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল,
-এই, সতিনের জন্য কি নেওয়া যায়?
-কি বললি?
-বললাম, ইহিতার জন্য কি নেওয়া যায়? ওর ফেভারিট জিনিস কি ছিল?
-টেডি বিয়ার।
মিথু গিফট শপের এক কর্নারে যেতে যেতে বলল,
-পেয়েছি।
-কি পেয়েছিস?
গিয়ে দেখি ইয়া বড় সাইজের এক টেডি বিয়ার। সাইজে আমার থেকেও বড় হবে। মিথু এইটা নেবে বলেই বায়না ধরল, কি করব, পেমেন্ট করে বেড়িয়ে পড়লাম, শপের লোকারা এসে গাড়ির পিছনে উঠিয়ে দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের ভিতর পৌঁছে গেলাম ইহিতাদের আপার্ট্মেন্টে। টেডি বিয়ার টা ওয়াচ ম্যান কে দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। আবির ভাইয়ার সাথে সাথে ঢুকলাম। কলিং বেলে চাপ দিতেই প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে দিল ইহিতা। আবির ভাইয়া বলল,
-হ্যালো, বাবু
-ওদের কোথায় পেলে?
-ধরে এনেছি।
বলে ভিতরে ঢুকে গেল সে। পিছু পিছু আমি আর মিথুও।
-হ্যালো ইহিতা। কেমন আছ?
-ভালো। তোমরা?
-হ্যাঁ ভালো
একবার তার সাথে চোখাচোখি হল। ইহিতা মনে হয় এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দরজা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আবির ভাইয়া আমাদের বসতে বলে নিজে বেডরুমে ফ্রেস হতে চলে গেল। সমস্ত ফ্লাট খুব সুন্দর করে সাজানো। বেশ চমৎকার, যত্ন করে সাজানো হয়েছে পুরোটা। পাশের বুক সেলফের উপর একটা জিনিস দেখে চোখ আটকে গেল। আরে, এইটা তো সেই ডল টা, যেটা আমি প্রথম গিফট দিয়েছিলাম ইহিতাকে।
.
তেমন কোনো লোকজনের সমাগম দেখলাম না, তাই আমরা ৪জনই কেক কেটে ইহিতাকে উইশ করলাম।আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, মিথিলার ফূর্তিটা একটু বেশি। কেন সেটা ধরতে পারছি না। ডিনারও করলাম একসাথে। হঠাৎ আবির বলল,
-অভ্র
-জ্বি ভাইয়া
-ড্রিংস কর?
-না ভাইয়া।
চল আজকে এক পেগ হয়ে যাক। না করতে পারলাম না। আড্ডা শেষে নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। লিমিট ক্রস করিনি ।তবে বউ আমার শুধু লিমিট না, তার উপরের স্তর ক্রস করে ফেলেছে। রিসোর্টে ফিরতে হবে, আবির ভাইয়া কে জানালাম, সে নামিয়ে দিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু তার যে অবস্থা, সে ড্রাইভ করলে আমাদের ভব লিলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।তাই তাদের কাছে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম।
.
ট্যাক্সি রিসোর্টের খুব কাছে নামিয়ে দিল। পুরো রাস্তা মিথু আমার ঘাড়ে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল,ট্যাক্সি থেকে নেমে তাকে সামলে রাখতে আমার বেগ পেতে হচ্ছে।
-অভ্র
-বল
-আমি হাঁটতে পারছি না
-তা তো দেখতে পাচ্ছি।
সে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরল, উপায় না দেখে তাকে কোলে করে নিয়ে রুমে ফিরতে হল। বেডে শুইয়ে দিলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে তাই আমিও তার পাশে শুয়ে পরলাম।
বুঝতে পারছি না, উপরওয়ালা আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন.

~ঢুলু ঢুলু চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ১১টা বেজে গেছে। লাফ দিয়ে উঠলাম। রাতের নেশার ভাবটা এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। ক্ষুধাও লেগেছে নেহাৎ কম না। মিথু যে ঘুম দিয়েছে, আজকে বিকেলের আগে উঠবে কি না সন্দেহ হচ্ছে। তাকে ডাকলাম,
-মিথু
কোনো জবার দিচ্ছে না,
-এই মিথু
-হু [ঘুমের মধ্যে]
-এগার টা বেজে গেছে উঠবি না।
-না
নাহ, একে নিয়ে পারা যায় না, তাই বাধ্য হয়ে বেড়িয়ে গেলাম। টেবিলে বসেছি, তাকে ছাড়া খেতে মন সায় দিচ্ছে না। তাই ওয়েটারকে রুমে নাস্তা পাঠাতে বলে চলে আসলাম, এসে দেখি সে এখনো বেডে শুয়ে, ব্রাশ খুঁজে নিয়ে তার কাছে গেলাম। জোর করে বেড থেকে নামিয়ে এনেছি, সে আমার ঘাড়ে মাথা দিয়ে কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে,
-অভ্র, ছাড় না। আমার খুব ঘুম পেয়েছে।
-পরে ঘুমাস! এখন ফ্রেস হয়ে নে। নাস্তা করতে হবে আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
কথাটি ম্যাজিকের মত কাজ করল,
-তুই নাস্তা করিস নি?
- না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়।
সে সাথে সাথে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। আমিও পশ্চাৎ প্রসারণ পূর্বক বেডের উপর গিয়ে বসলাম। অপেক্ষা করতে করতে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে,
-মিথু
-কি হয়েছে?
-এত সময় লাগে?
-শাওয়ার নিয়ে বের হব।
কিছু করার না দেখে বসে থাকলাম। ফোন নিয়ে কতক্ষণ গুতোগুতো করলাম, ভালো লাগছে না। কি করার যায় ভাবতে ভাবতে একখানা চিঠি লিখতে বসে গেলাম। কি লিখব ভেবে পাচ্ছি না। কিছু সময় পর, মিথু টাওয়াল পরে ভেজা চুলে ওয়াশরুম থেকে বের হল। ওর চেহারা থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। আচ্ছা, কোনো মনীষি কি বলেছিল, ভেজা চুলে মেয়েদের সব থেকে বেশি সুন্দর লাগে? মনে পরছে না! নিজেরই মনে হয় সাহিত্য রচনা শুরু করতে হবে আমার পিচ্চি বউ কে নিয়ে। এসে একদম আমার পাশে বসল, ওর চুল থেকে মন মাতানো সুঘ্রাণ আসতে শুরু করেছে,
-ঐ
ওর কথা শুনে বাস্তবে ফিরে আসলাম।
-হু বল।
-নাস্তা খাবি না?
-ও হ্যাঁ।
সে উঠে গিয়ে নাস্তা নিয়ে আসল। আবার আগের জায়গায় এসে বসল,
-নাও।
এ কি, বউ আমার আজকে নিজেই খাইয়ে দিতে চাইছে? বাহ
-এই শোন, আজকে বিকেলে ফ্লাইট। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
-কি? আমাদের না দশ দিনের ট্রিপ ছিল?
-হ্যাঁ জানি। আমার ভালো লাগছে না। যার সাথে গত ৬ বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না, আমি চাইছি না আবার তার মায়ায় আবদ্ধ হতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি। আমি ভালো থাকতে চাই। তোকে নিয়ে অনেকটা পথ হাঁটতে চাই। এর মাঝে নতুন করে কেউ কাটা হয়ে আসুক তা আমি চাই না।
-পারবি তো আমাকে আগলে রাখতে অভ্র?
কিছু বললাম না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলাম।
.
যেহেতু ট্রিপ শেষ হওয়ার আগেই বাড়িতে ফিরছি, তাই আগেই বাড়িতে ফোন দিয়ে জানানো দরকার। আম্মু ফোন দিলাম।
-হ্যালো আম্মু
-হ্যাঁ বাবা, বল
-আমরা ফিরছি আজকে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ফ্লাইট। তাহলে আমাদের দেশের সময়ে ৪.৩০ টায় ফ্লাইটে উঠব। তুমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলে দিও
-সে কি? তোদের না আরো কয়েকদিন পরে আসার কথা ছিল?
-হ্যাঁ ছিল। ভালো লাগছে না মা
-মিথুর সাথে কিছু হয়েছে?
-ওর সাথে কি হবে? আসলে মা, রিসোর্টের পাশে ইহিতাদের বাসা। আবিরের সাথে সেও এখানে থাকে। দেখাও হয়েছে কয়েকবার, আমি চাচ্ছি না, তার জন্য মিথুর সাথে আমার সম্পর্কের কোনো ভাঁটা পরুক। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-আচ্ছা, যা ভালো বুঝিস কর।
-ঠিক আছে আম্মু। রাখি তাহলে দেখা হচ্ছে খুব দ্রুত।
ফোন রেখে দিলাম।
.
তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে যেতে হবে, বোর্ডিং পাস নিয়ে সব কমপ্লিট করতে বেশ খানিক টা সময় লাগবে। তাই লাঞ্চ শেষ করে ৩টার মধ্যে বেড়িয়ে গেলাম। সকল ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে রওনা দিয়েছি। এখনকার রাস্তা ঘাট অনেকটা উন্নত। তাই বেশি সময় লাগবে না যেতে। আনমনে বসে আছি, হঠাৎ মিথু বলল,
-অভ্র, তোর চিঠিটা
অবাক হয়ে গেলাম। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক যেভাবে রুমে খাম বন্দি করে রেখেছিলাম সেভাবেই আছে। সে খুলেও দেখে নি।
-এটা কোথায় পেলি?
-রুম থেকে বের হবার সময় দেখলাম টেবিলের উপর রেখেছিস। ভাবলাম হয়ত কোনো জরুরী কিছু। তাও আবার ইহিতার এপার্ট্মেন্টের ঠিকানায় তাই নিয়ে এলাম।
-না আনলেই ভালো হত।
মনে মনে বললাম,
-কিছু বললি?
-না। খুলেছিলি?
-নাহ।
-জানতে চাইবি না, কি লেখা আছে?
-কি দরকার? কিছু কথা না হয় আমার অজানাই থাকল।
আমি মাঝেমধ্যে ভেবে পাই না, মেয়েটা এত ভালো কেন? আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না চিঠিটা পোস্ট করার। মিথুর জোরাজুরিতে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে পোস্ট বক্সে ফেলে আসলাম।
.
ভালোয় ভালোয় দেশের মাটিতে পা রেখেছি।রাত হয়েছে অনেকটা। এয়ারপোর্ট থেকে সকল ফর্মালিটি শেষ করে বাইরে এসে দেখি গাড়ি হাজির। উঠে পরলাম। শীতের তীব্রতা কিছুটা বেড়েছে মনে হচ্ছে। গাড়িটি তার চূড়ান্ত বেগ তুলে ছুটে চলেছে। হিম বাতাসে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গ্লাস উঠিয়ে দিতে বললে মিথু বারণ করল, তাই আর উঠাতে পারলাম না। তার নাকি ভালো লাগছে। এই মেয়েকে মনে হয় আমি এক জীবনে বুঝে উঠতে পারব না।
দেখতে দেখতে বাসার কাছাকাছি চলে আসলাম। গাড়ি থেকে নেমে কলিং বেল দিতে আম্মু দরজা খুলে দিল। মিথু সাথে সাথে গিয়ে আম্মুকে সালাম করল। কোনো মেয়ে দেশের বাইরে থেকেও এত রীতি নীতি মানতে পারে ওর অভ্যাস না দেখলে হয়ত আমি জানতে পারতাম না। আম্মুও তাকে আদর করে দিল। আসলে তার ভালোবাসার কোনো কমতি হবে না, কারণ আমার পরিবারে আমিই একা সন্তান। আর ছোট থেকে মিথুকে আম্মু খুব ভালোবাসত। এখন আমার ভয় হচ্ছে, আম্মু আমাকে ভুলে না যায়...
.
রুমে এসে ডিরেক্ট বিছানায় শুয়ে পরেছি। কেন জানি না মনে হচ্ছে, দুনিয়ার সকল ক্লান্তি আমার উপরে ভর করেছে। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, মিথুর সতিন দুঃখিত আমার কোলবালিশ সাত জনম পর কাছে পেয়েছি। মিথু ঘরে এসেই শুরু করল,
-অভ্র, ভালোয় ভালোয় কোলবালিশ আমার কাছে দিয়ে দে
-দিব না। কি করবি?
-দেখতে চাস?
-হু
সে গগন ফাটানো চিৎকার দিয়ে আম্মুকে ডাক দিল,
-ফুপ্পিইইইইইইইইইইইহ
আম্মাজানও আমার রকেটের গতিতে আমার রুমে হাজির।
-কি মা, কি হল তোদের?
-দেখ না ফুপ্পি, তোমার ছেলে আমার জায়গায় কোলবালিশ দিয়ে রেখেছে।
-অভ্র, দে কোলবালিশ দে, এক্ষুনি। আমার ভুল হয়েছে, আগেই সড়িয়ে রাখা উচিত ছিল।
.
আম্মু যেহেতু বলেছে, না করার কোনো উপায় দেখছি না। সুবোধ বালকের মত দিয়ে দিলাম।হন হন করে আমার দ্বিতীয় বউখানা নিয়ে আম্মু চলে গেল। আর অন্য দিকে বউয়ের মুখে বিজয়ীর হাসি দেখা যাচ্ছে। মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল। কোনো রকম জামা কাপড় চেঞ্জ করে বিছানায় শুয়ে পরলাম। কিছুক্ষণ পর মিথুও এসে পাশে শুয়ে পরল,
-ওগো।
-রাখ তোর ওগো। আমি কোলবালিশ এনে দিবি তুই!
-আমি আছি না?
কথা শেষ করার আগেই অন্য দিকে ঘুরলাম, সে আমার গেঞ্জির হাতা ধরে টানতে শুরু করেছে,
-তুই এমন করলে আমি ঘুমবো কি করে?
এবার তার দিকে ফিরলাম, দুষ্ট এক হাসি দিয়ে বাচ্চাদের মত আমার বাহুতে শুয়ে পরল।
.
সকালের মিষ্টি আলো মুখে পরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখি মিথিলা পাশে নেই। কোনো ব্যাচেলার যদি সকালে উঠে ফোন পাশে না পায়, ঠিক তখন যে কষ্ট টা লাগে তেমনই এক সদ্য বিবাহিত মানুষ ঘুম থেকে উঠে তার বউকে পাশে না দেখতে পেলে অবস্থা একই হয়। চোখ ডলতে ডলতে রুম থেকে বেরিয়ে আম্মুর কাছে যাচ্ছি, গিয়ে দেখি সেও রুমে নেই। আব্বু এখনো ঘুম। বউ শ্বাশুড়ি মিলে সাত-সকালে গেল কোথায়? ডাইনিং রুমে গিয়ে রান্না ঘর থেকে আম্মুর গলা শুনতে পেলাম।
-আরে মা, তুই ছাড় নাই, বুয়া আছে ওরা করে দিবে।
আগ্রহ নিয়ে গেলাম সেখানে, গিয়ে দেখি বউ আমার মহানন্দে রান্নার উৎসব বসিয়েছে। আর আম্মু পাশে বসে আছে।
রুমে ফিরলাম, ভাবলাম আরো কিছুক্ষণ ঘুমানো যাক, যে ভাবা সেই কাজ। আরাম করে শুয়ে পরলাম।
.
হুট করে কে যেন রুমে এসে এক জগ পানি আমার গায়ে ঢেলে দিল। লাফ দিয়ে উঠলাম। দেখি বউ আমার ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে,
-কি হে জনাব? নাস্তা খেতে হবে না?
-সে জন্য তুই গায়ে পানি ঢেলে দিবি?
-ফুপ্পি তো বলেছিল, তোর কান টেনে তুলতে। কিছুটা মায়া দেখিয়েছি। থাক থ্যাংক্স দিতে হবে না।
ক্রুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম,
-উঠে নাস্তার টেবিলে চলে আয়, নাস্তা দিয়েছি?
-দিয়েছি মানে?রান্না তুই করেছিস?
-হ্যাঁ জনাব
-হে উপরওয়ালা, মুখে দিতে পারলে হয়।
.
কিছুটা রাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেল মিথু, আমিও তার কিছুক্ষণ পরে নাস্তার টেবিলে চলে গেলাম, আম্মু আব্বু সবাই হাজির আমার সামনের চেয়ারে মিথু মুখ গোমরা করে বসে আছে!
-শুভ সকাল
-হুম বাবা, শুভ সকাল
নাস্তা খেতে শুরু করে আমি তো পুরো অবাক। একদম আম্মুর মত রান্না। অসাধারণ। কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসলাম। আমার আগেই মিথু ফিরেছে, বান্দারায় গিয়ে একা মন মরা হয়ে বসে আছে, গিয়ে পিছ থেকে জড়িয়ে ধরলাম,
-কি হয়েছে তোমার?
-কিছু না। ছাড়
-বলবি না? ভালো কথা রান্না টা খুব সুন্দর হয়েছে। আমি তখন একটু মজা করেছিলাম।
-সত্যি
-হুম, তা আর কি কি পারেন আপনি?
-তা না হয় সময় আসলেই দেখতে পাবেন জনাব.....

অনেকটা সময় একত্রে পাড় করেছি পাগলীটার সাথে, তাই জীবনটা রুটিন মাফিক হয়ে এসেছে।
সকালে মিথুর মিষ্টি কন্ঠে ঘুম ভাঙ্গে, নাস্তা করে অফিসে যাই, লাঞ্চ টাইমে সময় পেলে বাসায় আসি, নাহলে মিথু নিজে খাবার নিয়ে অফিসে চলে যায়। সারাদিন যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়। কখনো ভাবতে পারি নি, মিথুর মত একটা মেয়ে, এত সংসারি হয়ে উঠবে, আম্মু তার হাতে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বিশ্রাম করছে। আর সেও একহাতে আম্মুর দেখাশুনো দেখে শুরু করে আমার খেয়াল রাখা, সকল কিছু একহাতে সামলাচ্ছে।আজকাল রান্না-বান্নার কাজটাও নিজে করতে শুরু করেছে। তাতে আমার অবস্থা কিছুটা বিপন্ন, কারণ আম্মাজান আমাকে ভুলে তার বউকে নিয়ে সব কিছু করছেন। যাক ভালোই হল, নিজের উপর এখন এতটা চাপ আসে না।
.
কিন্তু আব্বু বিশেষ একটা কাজে দেশের বাইরে যাওয়ায় একা সকল দিক দেখতে হচ্ছে। অফিসের বাইরে ফ্যাক্টরিগুলোতে বেশি সময় দিতে হচ্ছে, আজকে হুট করে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছি, আমার খেয়াল নেই মিথুকে ফোন দিয়ে বলে দিব আজকে আর বাসায় আসা হচ্ছে না, একদম মনে নেই। হাতে ফোন সব নিয়েছি এর মধ্যে মিথুর ফোন,
-হ্যালো
-হ্যাঁ বলো...
বলতে ভুলে গেছি, আজকাল বউ আমার, তুই বাদ দিয়ে তুমি ডাকতে শুরু করেছে। আমাকেও বাধ্য করে তাই করতে হচ্ছে।
-কোথায় আছ তুমি?
-একটু বাইরে এসেছি।
-লাঞ্চ করতে আসবে না?
-মনে হচ্ছে না। ফ্যাক্টরিতে এসেছি, তোমাকে ফোন দিব একদম খেয়াল ছিল না।
-ঠিক আছে
বলে রেখে দিল। রাগ করেছে পাগলীটা। আমি বাসায় না ফিরলে না খেয়ে বসে থাকবে। তাই শশব্যস্ত হয়ে সব কিছু শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হলাম। রাস্তা থেকে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে নিলাম। অনেকটা সময় পর বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। কলিং বেল দিতেই আম্মু দরজা খুলে দিল,
-কি রে বাবা, আজকে এত দেড়ি করলি কেন? মেয়েটা না খেয়ে বসে আছে।
-আসলে আম্মু, আমার একদম মনে ছিল না, আব্বু বাইরে যাওয়ায় অনেক বেশি চাপ পরছে আমার উপর।
-তাই বলে, আপন মানুষ গুলোর কথাও বেমালুম ভুলে যাবি?
-তুমি খেয়েছ?
-হ্যাঁ, মিথু আমাকে খাইয়ে দিয়ে রুমে গিয়ে বসে আছে।
-আচ্ছা আমি দেখছি।
.
ফুলটা পিছনে রেছে, রুমে গিয়ে দেখি মিথু শুয়ে আছে,
-মিথু
-এসছেন জনাব? না আসলে হত না?
কিছুটা অপরাধী ভঙ্গিতে বললাম,
-আসলে, জানই তো, কত দিক একা মানুষ সামাল দিতে হয়।
ফুলটা বের করে তার কাছে দিলাম,
-বাব্বাহ, ঘুষ দেওয়া শিখেছ?
-হা হা, শোন তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার দাও, আমি আসছি।
ফ্রেস হতে চলে গেলাম। রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা ডাইনিং রুমে চললাম, মিথু টেবিলে অপেক্ষা করছে। চেয়ার টেনে বসে পরার সাথে সাথে খাবার তুলে দিল, খাওয়া শুরু করেছি,
-আচ্ছা, প্রতিদিন আমার জন্য বসে থাকতে হয়? আম্মুর সাথে খেয়ে নিলেই তো পার।
-কখনো কি এমনটা হয়েছে?
-হয়নি তবে, ব্যস্ততা বাড়ছে। আর অনিয়ম করলে তো অসুস্থ হয়ে পরবে।
-কিছু হবে না। শোন, তোমাকে আর আজকে অফিসে যেতে হবে না।
-সে কি? কেন? কত কাজ বাকি পরে আছে।
-আমি শ্বশুড় মশাইয়ের সাথে কথা বলেছি, সে তোমাকে আর আম্মু কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যেতে বলেছে। আর অনেকদিন তো আমাদের বাড়িতে যাওয়া হয় না, তাই একটু খারাপ লাগছে।
-আম্মুর সাথে কথা বলেছ?
-হ্যাঁ। সে রাজি। আর আব্বুও দেশের বাইরে থেকে সোজা আমাদের বাড়িতে চলে আসবে।
ভালোই হল, অনেকদিন মিথুকে সময় দিতে পারছি না। আর যান্ত্রিকতার ভিতর থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছি।
.
সেদিন রাতেই আম্মু আর মিথুকে নিয়ে মামা বাড়ি দুঃখিত শ্বশুড় বাড়িতে রওনা দিলাম। অনেকটা পথ, আর সারাদিনের ক্লান্তি, সব মিলিয়ে যদিও কিছুটা শোচনীয় অবস্থা। তারপরেও কিছু করার নেই। সারা রাতের গাড়ি জার্নির পর ভোরে পৌঁছে গেছি। কিন্তু গিয়ে মোটামুটি সাইজের ছ্যাকা খেলাম। পুরো বাড়ি সেই আমাদের বিয়ের দিনের মত সাজানো। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মিথুর কোনো বোন নেই। সেও আমার মত একা। তাই কারো বিয়ে হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এভাবে সাজানোর মানে কি?
.
কলিং বেল টিপতেই শ্বশুড় শ্বাশুড়ি একত্রে দরজা খুলে দিল। তাদের হাসি মুখ দেখে কিছুটা সন্দেহ হচ্ছে,
-কেমন আছিস তোরা?
আমি কিছু বললাম না, মিথু জবাব দিল,
-ভালো। তোমরা?
-হ্যাঁ ভালো।
বলেই ভিতরে ঢুকে গেল। আমি সোজা মিথুর রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর সে ও রুমে চলে আসল।
-এই শোন
-হুম বল
-তোমার বাবা কি আবার বিয়ে শাদী করবে নাকি?
-যাহ্‌ শয়তান, কি বলছ এইসব?
-তাহলে বাড়ি সাজিয়েছে কেন?
-আমাদের বিয়ের পরে আগামী পরশু আমার প্রথম জন্মদিন। তাই সবাই একসাথে সেলিব্রেট করবে তাই।
-ওহ
.
সেড়েছে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, মিথুর বার্থডে সামনে। কোনো এক অজানা কারণে আমি কারো জন্মদিন মনে রাখতে পারি না। এমন কি, নিজের ক্ষেত্রেও, কেউ যদি উইশ না করে তাহলে বলতে পারি না আজকে আমার জন্মদিন। পরলাম আরেক বিপদে। বিয়ের পরে তার প্রথম জন্মদিন, কিছু একটা না দিলে কেমন লাগে? হয়ত সে মুখ ফুটে কিছু চাইবে না, কিন্তু নিজের কাছে খারাপ লাগছে। আব্বুকে ফোন দিলাম,
-হ্যালো, আব্বু
-জ্বি বাবা, বল
-আপনি কি আজকেই ফিরবেন?
-হ্যাঁ, এইত কিছুক্ষণ পরেই ফ্লাইট। হোটেল থেকে বের হব।
-আসলে আব্বু, একটা সমস্যা পরেছে।
-কি হয়েছে বাবা, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
-আসলে সবই ঠিক আছে, কিন্তু আপনি তো মিথুদের বাড়িতে চলে আসতে বললেন, আমরা আম্মুকে নিয়ে চলেও এসেছি।আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, মিথুর জন্মদিন। কিছু একটা না দিলে কেমন দেখায়?
-ঠিক আছে বাবা, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করছি।
-TanQ আব্বু
-Always welcome
বলে ফোন রেখে দিলাম। যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। আসলে দুনিয়াতে বাবাগুলো কেন জানি না অনেক বেশি ভালো হয়। তারা জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সন্তানের মাথার উপর বট বৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে যায় নিঃসার্থ ভাবে। দুনিয়াতে হয়ত খারাপ পুরুষ থাকতে পারে। কিন্তু খারাপ একজন বাবা নেই..
.
সারা রাত গাড়ির জার্নি করে এসেছি, ভাবলাম একটু বিশ্রাম নিব, তা আর হচ্ছে কোথায়? বাড়ি ভর্তি মানুষজন, হৈ চৈ লেগেই আছে। তবে সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষকে আমি চিনি না। আম্মু ধরে ধরে একেক জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, আর আমি সুবোধ বালকের মত দেখে যাচ্ছি। মিথু এসেই তার দুঃসম্পর্কের এক বোনের বাবু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ব্যক্তিগত ভাবে বাচ্চাদের আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু এই বাচ্চাটাকে কেন জানি না একটু বেশি ভালো লাগছে। তাই আমিও মিথুর সাথে বাবুটাকে নিয়ে ছাঁদে চলে গেলাম। হঠাৎ আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। আমার কোল থেকে বাবুটাকে মিথুর কাছে দিয়ে ওর মায়ের কাছে রেখে আসতে বললাম। বৃষ্টির পানি গায়ে পরলে হয়ত ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। মিথুও তাই করল। সে নিচে চলে গেল। আমি ছাঁদের কর্নারে রাখা দোলনায় একা বসে থাকলাম। মুষল্ধারে বৃষ্টি শুরু হল। তারপরেও বসে থাকলাম, মিথুও চলে আসল প্রায় সাথে সাথেই,
-এই, নিচে যাবে না? বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে তোমার!
-আসুক। অনেক দিন একসাথে ভেজা হয় না।
সে মৃদু হেসে আমার পাশে এসে বসে পরল,
-হয়ত উপরওয়ালা আজ খুব খুশি, তাই এত সুন্দর বৃষ্টি উপহার দিচ্ছেন
-হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ
-হয়ত আরো কিছু উপহারও রয়ে গেছে।
-যেমন?
-সেটা না হয় কালকে জানতে পারবে।
জন্মদিন তার, অথচ উপহার আমার জন্য অদ্ভুত।
.
সকাল সকাল উঠে পরেছি আজ, চারিদিকে ব্যস্ততা। এক কাপ চা পর্যন্ত খাওয়া হয় নি, রুম থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি, এর মধ্যে আব্বুর সাথে দেখ,
-এই যে অভ্র, তোমাকেই খুঁজছিলাম
-কেন আব্বু?
-এই নাও, যেটার কথা বলেছিলে।
আমার হাতে প্যাকেটে মোড়ানো কি যেন একটা হাতে দিয়ে আব্বু চলে গেল। আবার রুমে ঢুকলাম। খুলে দেখি, মিথুর জন্য ডায়মন্ড রিং। বাহ, অসম্ভব রকম সুন্দর, বলতে দ্বিধা নেই, আমার থেকে আমার বাবার পছন্দ অনেক বেশি ভালো। মিথুর আজ সারাদিন দেখা নেই। আমিও খুব একটা চিন্তা করলাম না। অনেক দিন পর এসেছে বাবার বাড়িতে হয়ত সকলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রুমে এসে আমিও রেডি হয়ে বের হলাম, তার দেখা মিলল সন্ধায় কিছুটা আগে, একেবারে পরীর মত লাগছে তাকে। নীল রঙ এর শাড়িতে তাকে অসম্ভব রকমের সুন্দর মনে হচ্ছে।দু’চোখের পাশের কাজল দেওয়াতে চোখের গভীরতা কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গেছে। মনে হয় সে গভীরতা মাপতে গেলে আমি অতলে হারিয়ে যাব।
.
ডাক পড়ল তাই দুইজন একত্রে গেলাম, কেক কাটলাম, ফর্মালিটি শেষ করে, তার হাত ধরে, রিং টা পরিয়ে দিলাম। অনেক বেশি অবাক হয়েছে পাগলীটা। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।মৃদু একটু হাসি দিলাম। হুট করে সে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-তোমার উপহার’টির শুনবে না?
- কি?
-তুমি বাবা হতে যাচ্ছ...
.
~বাড়িতে ফিরেছি। সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর অনেকটা বেশি সতর্ক হয়েছি, পরিবার বলতে বাবা মা আর মিথু। আমি চাই না এদের কেউ আমার জীবন থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে যাক।
ব্যস্ততা বাড়ছে। মিথুকে পরিপূর্ণ সময় দিতে পারছি না। আম্মু তার দেখাশুনো করছে। তবু এখনও সে দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে অফিসে চলে আসে। বারণ করেছি অনেকবার। কিন্তু কে শুনছে কার কথা। অফিসের বাইরে থাকলে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। আজকে সকাল ১১ টার দিকে কাজে বেড়িয়েছি। গুরুত্বপূর্ন মিটিং এ যেতে হবে। মিথুকে ফোন দেওয়ার কথা একদম খেয়াল ছিল না। মিটিং এর মাঝখানে একবার ফোন দিয়েছিল অবশ্য ধরতে পারি নি। অফিসে ফিরে দেখি সে আমার কেবিনে বসে আছে,
-এসেছেন জনাব?
-তুমি অফিসে কেন? তোমাকে না বারণ করেছিলাম এখন বাড়ি থেকে কম বের হতে।
-কথা বলে পেট ভরবে? নাকি লাঞ্চ করতে হবে?
ফ্রেস হয়ে এসে বসলাম,
-মিথু, তোমার ভালোর জন্য বলছি, প্লীজ একটু কম বের হবে বাড়ি থেকে। তুমি এখন একা না।
-তুমিও শুরু করলে? আচ্ছা, শোন, আজকে বিকেলে চেক আপ করতে যাবার কথা ছিল। আমার সাথে একটু যেতে পারবে???
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.
অফিস থেকে সোজা ডাক্তারের চেম্বারে চলে গেলাম। কয়েকটা টেস্ট দিয়ে সেগুলো করতে বলল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। টেস্ট গুলো শেষ করে তাকে নিয়ে বাড়ীতে ফিরলাম। রিপোর্ট পরের দিন দিবে তাই কাল আবার যেতে হবে। রাতের খাবার সবাই একসাথে খেতে বসেছি, আব্বু বলল,
-অভ্র, তোমার কাল থেকে অফিসে যেতে হবে না। ঐ দিকটা আমি সামলে নিব। তুমি মিথিলাকে আর তোমার মাকে সময় দিবে।
-ঠিক আছে।
.
তারপর টুকটাক কথা বলে মিথুকে নিয়ে রুমে চলে গেলাম। সারাদিন পরে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসল। মিথুর কথায় আবার জেগে উঠলাম,
-এই শোন না।
-হুম বল
-তোমাকে খুব চিন্তিত লাগছে। কারণ টা জানতে পারি?
-কোথায়, না তো!
-আমার কাছে লুকাবে তুমি?
-আরে পাগলী, কিছু হয় নি, আগামী কাল রিপোর্ট আসবে সে জন্য একটু চিন্তা লাগছে।
-আচ্ছা, ঘুমাও তাহলে। খুব ক্লান্ত নিশ্চয়ই।
কিছু না বলে ঘুমিয়ে পরলাম। মিথুর ঘুমোতে অনেক বেশি কষ্ট হয় জানি। অনেক রাত চোখে ঘুম থাকা স্বর্ত্বেও ভোর হয়ে যায়। তবুও আমাকে কখনো সাহস করে ডাকে না। কখনো ঘুম ভেঙ্গে গেলে হয়ত দেখি, সে পাশে বসে আছে।
একমাত্র মায়েরা জানে কলিজার টুকরো একজন সন্তান জন্ম দিতে কতটুকু কষ্ট করতে হয়।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা আম্মুর রুমে চলে গেলাম। মিথু ঘুমচ্ছে। রাতে হয়ত ভালো ঘুম হয় নি। তাই ডাকলাম না।
-আম্মু
-হ্যাঁ বল বাবা। কি হয়েছে?
-আজকে আমি রান্না করব!
-পাগল হয়েছিস নাকি?
-একটুও না। ফ্রিজে কি মাংস আছে?
-হ্যাঁ। কেন?
-মিথিলার বিরিয়ানি খুব পছন্দ। সেটা রান্না করব।
-হা হা, আচ্ছা ঠিক আছে।
কি মনে করে যেন হাটতে বেড়িয়ে পরলাম, কিছুটা দূরে এসে আমার বাসার দিকে ফিরতে যাব, দেখি একটা বাচ্চা ছেলে বেলি ফুলের মালা নিয়ে মাত্র বের হয়েছে। আমাকে দেখে বলল,
-ভাইয়া, ফুল নিবেন নি? নেন, আফার খুব পছন্দ হইবো।
বেলিফুলের ঘ্রাণ টা অসাধারণ। তাই নিয়ে নিলাম।
রুমে এসে দেখি, মিথু শাওয়ার নিয়ে মাত্র বেড়িয়েছে। চুল শুকিয়ে নিজে তার খোপা বেঁধে, ফুলের মালা লাগিয়ে দিলাম। বাহ, অসাধারণ লাগছে দেখতে।
.
আমাকে কিচেন রুমে দেখে মিথুর চোখ চড়ক গাছে উঠেছে,
-এই, তুমি এখানে কেন?
-রান্না করব!
-পাগল হয়েছ?
-একটুও না।আজকে দেখবে, তোমার বর কত কিছু করতে জানে।
-থাক দেখাতে হবে না। এখনই বের হও এখান থেকে!
-তুমি আম্মুর কাছে যাও। কি জন্য যেন ডেকেছিল।
আসলে মিথ্যে কথা, আম্মু ডাকে নি। এখানে থাকলে সে আমাকে রান্না করতে দিত না।
.
সব সময় সে আমার জন্য কয়েছে । এখন না হয় তার জন্য কিছু করার সময় এসেছে।
আব্বুও আজকে লাঞ্চ করতে বাসায় ফিরেছে, একত্রে টেবিলে বসেছি, খেতে শুরু করেছি সবাই, আব্বু বলল,
-অভ্রর আম্মু, আজকে রান্নাটা অন্য রকম লাগছে। রাঁধুনি কি চেঞ্জ হয়েছে নাকি?
মিথিলা হাসতে হাসতে জবাব দিল,
-বাবা, আজকে আপনার ছেলে রান্না করেছে।
আব্বু অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একটু পরে আম্মু আব্বু দুজনই মিথুর সাথে হাসিতে যোগ দিল। আমি বললাম,
-রান্না কি ভালো হয় নি?
-অসাধারণ হয়েছে। কিন্তু বাবা, হঠাৎ কি মনে করে?
-এমনি আর কি...
.
দুপুরের পরে মিথুকে নিয়ে বের হলাম, প্রথমে রিপোর্টগুলো চেক করাতে হবে। অপেক্ষার প্রহর গুনে চলেছি। ডাক পড়ল চেম্বার। তাকে নিয়ে গেলাম সেখানে, ডাক্তার আমাদের দেখেই বল,
-আসুন আসুন, শুভ সংবাদ, আপনাদের মেয়ে আসছে খুব দ্রুত। কনগ্রেট মি & মিসেস অভ্র.
.
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আনন্দে চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল চিবুক বেয়ে নেমে পড়ল। মানুষ শুধু দুঃখ বেদনায় কাঁদে না। আনন্দেও কাঁদে।সে আরো বলল,
-নরমাল ডেলিভারি হবে তাই চিন্তার কারণ নেই।
কাছাকাছি একটা ডেটও দিয়ে দিলেন। ডাক্তারের কেবিন থেকে বেড়িয়ে মিথু প্রথমে ফোন দিয়ে আমার আম্মু কে জানাল তার পরে তার বাবা মা কে। আমার এখনই ডান্স করতে ইচ্ছে হচ্ছে, অনেক কষ্টে ইচ্ছেটা সংবরণ করতে হল।
.
ভেবেছিলাম ঘুরতে যাবো, কিন্ত মিথু নিষেধ করল, তাই মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ঢোকার সাথে সাথে আম্মু আজকে মিথুকে মিষ্টি খেরাপি দিল, তারপর আমাকে। পায়ে ধরে সালাম করলাম। আম্মু আমাদের বুকে জড়িয়ে নিল। এত বড় একটা খুশির খবর...
.
আমার বেশির ভাগ সময় মিথুর কাছে বসেই কাটছে। নিজের ভিতর অনেকটা পরিবর্তন অনুভব করতে পারছি। কেন জানি না, মিথুকে হারানোর ভয় আমাকে সব সময় আতংকিত করে রেখেছে। একে কি তার জন্য ভালোবাসা বলা যায়? জানি না! কখনো জানতে ইচ্ছে হয় নি। তবে যতটা ভয় ইহিতাকে হারানোর ছিল তার থেকে মনে হয় কয়েক শত গুন বেশি ভয় এখন কাজ করছে। মিথুকে এক মুহুর্ত চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে হয় না। যত দিন ঘনিয়ে আসছে, তত চিন্তা বাড়ছে, যদিও সে আমাকে সব সময় সাহস দিয়ে যাচ্ছে, তবুও, ঘর পোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। ভাগ্যের হাতে এত মার খেয়েছি, যা বলার ভাষা নেই।
.
রাত প্রায় ২টা পার হয়েছে, ঘুমিয়ে আছি, পাশে মিথু। হঠাৎ সে চিৎকার দিয়ে উঠল,
-অভ্র
-মিথু, কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? সব কিছু ঠিক আছে তো?
-খুব ব্যথা হচ্ছে। মনে হয় জীবনটা বেড়িয়ে যাবে।
বুঝলাম সময় হয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি আম্মু আব্বু ডেকে তাকে এ্যাম্বুলেন্সে করে হসপিটালে নিয়ে গেলাম, পুরোটা সময় তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছি। সে শুধু একটা কথা বলছিল,
-আমার কিছু হলে বাবুকে দেখে রেখ।
-দূর, পাগলী, আমি থাকতে কিচ্ছু হবে না।
তার কষ্ট দেখে নিজের বুকের ভিতর ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
ডাক্তারের কথা মত প্রথমে নরমাল ডেলিভারি করার জন্য চেষ্টা করা হল। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ফলপ্রসু কিছু হচ্ছে না। ডাক্তার বাইরে এসে আমাকে আগে ডাকলেন,
-মি.অভ্র
-জ্বি। কি অবস্থা পেসেন্টের?
-কিছুটা সংকটপূর্ন। আমাদের c সেকশনের জন্য এগোতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের ব্লাড ব্যাংক এ, আপনার স্ত্রীর গ্রুপের O- রক্ত নেই। যত দ্রুত সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল। ঘড়ির কাটা ৩ টা ছুই ছুই করছে, এই সময় কোথা থেকে রক্ত ব্যবস্থা করব? আব্বুকে জানালাম। আম্মু শুনো রীতিমত কান্না জুড়ে দিয়েছি। নিজের মেয়ের মত করে ভালোবাসে মিথুকে। আম্মুকে কি শান্তনা দিব? নিজেকে বুঝাতে পারছি না। তবে কি আমার ধারণ আরো একবার সত্যি হতে যাচ্ছে?
.
বাবা আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে বেড়িয়েছেন রক্ত জোগাড় করতে। কিন্তু এ রাতে কি থেকে কি করবেন? করিডোরে ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে কিছু চিন্তা করতে পারছি না। নিজেকে জড় পদার্থ মনে হচ্ছে। হঠাৎ কে যেন আমার ঘাড়ে শীতল হাত রাখল, ঘুরে দেখি এক মধ্য বয়স্ক চমশা পরিহিত ভদ্র লোক দাঁড়িয়ে আছেন,
-কোনো সমস্যা?
মুখ দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারছিলাম না। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। কি হল জানি না, হুট করে সব সমস্যার কথা হড়্গড় করে বলেদিলাম, সব শুনে তিনি মুচকি হেসে বললেন,
-নিয়তির কাছে সব সময় হেরেছেন? এবার না হয় আমার কিছুটা অংশ আপনাদের দিয়ে গেলাম।
-দুঃখিত , বুঝলাম না।
-বোঝানোর জন্য বলি নি। যাই হোক আমারই তো O-. আপনাদের অপত্তি না থাকলে আমি সাহায্য করতে পারি।
.
আমার চোখ চক চক করে উঠল, দৌড়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি অপরিচিত লোকটির রক্ত পরীক্ষা করে উপযুক্ত বলে গন্য করলেন।রক্ত সংগ্রহ করে OT তে নিয়ে যাওয়া হল। সেই লোকটি আমার পাশে এসে বলল,
-অনেক বেশি ভালোবাসেন তাই না? তবে ভালোবাসারই জয় হোক!
-দুঃখিত, আপনার কথা কিছু বুঝলাম না!
-বাদ দি।সব কিছু বুঝতে হয় না। আচ্ছা আসি তাহলে।
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেল। আর দেখতে চোখে আড়ালে চলে যাওয়ার আর দেখতে পারলাম না তাকে। একটু পরই শুরু হল অপারেশন। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে আমার বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে! প্রায় সাথে সাথেই মুখ কালো করে আব্বু ফিরেছেন,
-কিছু করতে পারলাম না বাবা।
আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, রক্তের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আব্বু অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,
-কে দিয়েছে?
-তাকে চিনি না, আগে পরে দেখেছি বলে মনে পরছে না। তবে মধ্য বয়স্ক ভদ্র লোক মনে হল...
আব্বু আমার কথা শুনে মনে হয় চমকে উঠলেন।
-অভ্র, উনি কি চমশা পরে?
-হ্যাঁ। কেন?
-আরে এই তো সেই লোক, যিনি...
আব্বু কথা শেষ করতে পারলেন না, তার আগে OT থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসল। সকল কল্পণা জল্পণার অবশান ঘটিয়ে এসেছে আমার মামুনি, আমার আয়েশা।
ডাক্তার বের হল, গিয়ে তাকে ঘিরে ধরলাম,
-অভিনন্দন মি.অভ্র। আপনার কন্যা সন্তান হয়েছে। মা এবং মেয়ে উভয়ে ভালো আছেন। একটু পরে চাইলে দেখা করতে পারবেন।
আব্বুকে জড়িয়ে ধরলাম। খুশিতে তার চোখ দিয়েও দু-ফোটা পানি গড়িতে পরছে। অবাক লাগল, কোন দিন এই মানুষটির চোখে পানি দেখি নি...
.
নার্স এসে মেয়েকে আমার বাবার কোলে দিয়ে গেল। বাবা এখনো কাঁদছেন, আর আম্মুর খুশি তো মনেই ধরছে না। প্রথম বারের মত মেয়ের দিকে তাকালাম, বাহ, একদম মায়ের মত চেহারা হয়েছে। স্বপ্নটা বোধহয় এবার সত্যি হতে চলেছে। দেখলাম ঘুমিয়ে আছে। আব্বু আমার কোলে দিল। খুব সাবধানে তাকে নিয়ে বসে রইলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমার মেয়ের দিকে।আমার মেয়ে, হ্যাঁ আমার মেয়ে। আমি বাবা হয়েছি। সকল অশুভ কিছু পার করে এসেছি? তবুও সব কিছু কেন জানি স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। কত সময় বসেছিলাম মনে নেই। নার্সের ডাকে বাস্তব জগতে ফিরে আসলাম।
-মি.অভ্র, আপনার পেসেন্টের সাথে চাইলে দেখা করতে পারেন।
আমি আয়েশা কে নিয়ে মিথুর কেবিনে গেলাম। সে চোখ বন্ধ করে আছে। গিয়ে আস্তে করে ডাকলাম,
-মিথু
আমার গলা শুনে চোখ মেলে তাকাল। কথা বলতে পারছে না। তবে এক ফোঁটা জল চোখের কণা দিয়ে বেয়ে পরছে। আমি জানি এই জল আনন্দের। আয়েশাকে তার পাশে শুইয়ে দিলাম। অনেক কষ্টে হাত টা উঠিয়ে বাবুর গাল স্পর্শ করল। আজ মনে হচ্ছে আমি সকল অশুভ কিছুকে পিছে ফেলে এসেছি। এখন সময়টা শুধু আনন্দের। সময়টা শুধু আমাদের।
.
.
.
.
.
-আব্বু, আব্বু, এই আব্বু
-কি হয়েছে মামুনি?
-আমাকে শক গাম এনে দিবে আজকে?
-সে কি? শক গাম কেন? কি করবে?
-রনওক নামে পাজি একটা ছেলে আছে আমাদের ক্লাসে, তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
শুনে শুধু একবার হাসলাম, আসলেই তো একদম মায়ের মত হয়েছে, এখন সে আমার পিচ্চি মেয়ে...
.
………………সমাপ্ত………………
((ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করে সাথেই থাকুন 💝 এবং সবাই এড করে নিন 💝 এবং সবাই আমার নতুন পেইজ এ লাইক করুন)